- বাংলাদেশ
- গ্রাম থেকে নগর সর্বত্রই বিজয়ের আনন্দ আয়োজন
গ্রাম থেকে নগর সর্বত্রই বিজয়ের আনন্দ আয়োজন

মহান বিজয় দিবসে শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ছায়ানটের হাজারো কণ্ঠে দেশগান-মামুনুর রশিদ
বিজয় মানেই আনন্দ, বিজয় মানেই উচ্ছ্বাস। তারুণ্যের বাঁধভাঙা জোয়ার। হাতে হাতে লাল-সবুজের পতাকা। দেশের মানচিত্র ও পতাকার উল্ক্কিতে আবির রঙে রাঙা মুখ। গতকাল শুক্রবার মুক্তির আনন্দ ছুঁয়ে গেছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারের বাংলাদেশকে। দেশমাতৃকার তরে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দের বাতাবরণ। মহাসমারোহে গলি থেকে রাজপথ, গ্রাম থেকে নগর- সর্বত্রই বিজয়ের আনন্দ। শহীদের স্মৃতির মিনারে যেমন শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে, তেমনি নাচ-গান, নাটক, প্রদর্শনীসহ বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপিত হয়েছে বিজয়ের ৫১তম বার্ষিকী। আধুনিক প্রযুক্তি ও সময় এনে দিয়েছে বিজয় উদযাপনের নতুনত্বের বহিঃপ্রকাশ। সাংস্কৃতিক কর্মীদের নির্ঘুম রাতের কষ্ট প্রাণ পেয়েছে জনতার আনন্দে।
হাজারো মুক্তকণ্ঠে ছায়ানটের 'দেশগান': সবাই মিলে দেশের গান গাওয়ার, দেশের কথা বলার প্রত্যয় নিয়ে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে 'হাজারো কণ্ঠে দেশগান' অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ছায়ানট। বিকেল পৌনে ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সবাই মিলে নৃত্যশৈলীর সঙ্গে মুক্তকণ্ঠে দেশগান গাওয়ার আয়োজনজুড়ে প্রতীকীভাবে জাতীয় পতাকার রং দিয়ে সজ্জিত করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান। সঙ্গে ছিলেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা ও সহসভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল।
এ আয়োজনে পরিবেশিত হয় আটটি সম্মেলক গান, সঙ্গে সম্মেলক নৃত্য। ছিল একক পরিবেশনাও। নৃত্যগীত পর্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে', 'এখন আর দেরি নয়'; জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'সঙ্ঘ শরণ তীর্থযাত্রা' ও 'চল্ চল্ চল্' সংগীতে সম্মিলিত নৃত্যগীত পরিবেশন করেন ছায়ানটের শিল্পীরা।
তবলা, ঢোল ও মন্দিরার দ্যোতনায় ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বাঙালির পূর্ণাঙ্গ বিজয়ের ক্ষণকে স্মরণ করে সম্মিলিত কণ্ঠে ৪টা ৩১ মিনিটে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়। মুক্ত প্রাণের প্রতিধ্বনি হয়ে সবার সম্মিলিত কণ্ঠে দেশের গান উচ্চারিত হওয়ার মানসে ২০১৫ সাল থেকে মহান বিজয় দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে দেশগান গাওয়ার আয়োজন করে থাকে ছায়ানট। ২০২০ সালে করোনা মহামারির ও গত বছর ঢাবির শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানের জন্য বিজয় দিবসের আয়োজন ওই স্থানে করা সম্ভব হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আট দিনব্যাপী বিজয় উৎসব: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজন করেছিল আট দিনব্যাপী বিজয় উৎসবের। ৯ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এই উৎসব শেষ হয় গতকাল ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে। গতকাল সমাপনী দিনে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তন এবং মিরপুরের জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠে অনুষ্ঠিত হয় শেষ দিনের উৎসবের অনুষ্ঠানমালা।
জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে সকাল ১০টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে শুরু হয় এ উৎসবের শেষ দিনের আনুষ্ঠানিকতা। 'শিশু-কিশোর আনন্দানুষ্ঠান' শীর্ষক আয়োজনে অংশ নেয় সোসাইটি ফর দি ওয়েলফেয়ার অব অটিস্টিক চিলড্রেন, কল্পরেখা, এসওএস শিশুপল্লী, বধ্যভূমির সন্তান দল, খেলাঘর, ইউসেপ বাংলাদেশ ও হাজারীবাগ গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা ৬টায় বাউল গান পরিবেশন করে কুষ্টিয়ার লালন আখড়া 'আরশীনগর'।
বিকেলে মিরপুরের জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠে স্মৃতিচারণ করেন জল্লাদখানায় শহীদের সন্তানরা। এরপর সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেয় চারুলতা একাডেমি, স্বপ্নবীণা শিল্পকলা বিদ্যালয়, ঢাকা সিটি স্কুল, বধ্যভূমির সন্তান দল, যুব বান্ধব কেন্দ্র, মিথস্ট্ক্রিয়া আবৃত্তি পরিসর, সংগীত সমাজ কল্যাণপুর, শৌখিন একাডেমি, পঞ্চায়েত শিল্প-সংস্কৃতি কেন্দ্র ও থিয়েটার গেরিলা।
শিল্পকলা একাডেমিতে নানা অনুষ্ঠান: বিজয় দিবস উদযাপনে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং শিল্পকলা একাডেমিতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এর মধ্যে সকাল ৯টায় সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও দেশের গানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
বিকেলে একাডেমির নন্দনমঞ্চে শিশুশিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একক সংগীত ও দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে একাডেমির শিশু নৃত্যদল। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুশিল্পীদের দল ক্যারিশমা 'স্বাধীনতা এই শব্দটি আমাদের'-এর সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে। অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তৃতা দেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। সন্ধ্যায় ছিল সমবেত নৃত্য, সমবেত সংগীত, কবিতা পাঠ ও অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী। এ ছাড়া অনুষ্ঠানস্থলে গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটারের পোস্টার প্রদর্শনী হয়েছে। এ ছাড়া দলীয় নৃত্য, একক ও দলীয় সংগীত পরিবেশন করে রবীন্দ্র সংগীত সমন্ব্বয় পরিষদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত বিভাগ, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্ব্বয় পরিষদের শিল্পীরা।
চ্যানেল আইয়ে বিজয় মেলা: বিজয় উদযাপনে চ্যানেল আই চেতনা চত্বরে অনুষ্ঠিত হলো চ্যানেল আই বিজয় মেলা। দিবসটি উদযাপনে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণ সেজেছিল লাল-সবুজ রঙে। বিজয়ের দিন সকাল ১১টায় ৫২টি লাল-সবুজ বেলুন ও সাদা কবুতর উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করা হয়। বিজয়ের ৫১ বছর পূর্তিতে মেলার উদ্বোধন পর্বে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য, স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীসহ বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। এবারের বিজয় মেলায় ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা প্রদান ও উত্তরীয় পরিয়ে দেয় চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষ। সম্মাননাপ্রাপ্তরা হলেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা নবীন হোসেন, কিসলু, আলী আজগর, হাসিম উদ্দিন, ওবায়দুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, শাখাওয়াত পাটোয়ারি ও হায়দার আলী খান। এ সময় চ্যানেল আইয়ের পরিচালক এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু জানান, প্রতি বছর ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। নাচ, দেশের গান, কবিতা আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা দিয়ে সাজানো ছিল এবারের বিজয় মেলা।
বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কর্মসূচি: মহান বিজয় দিবসে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সকালে বিজয় শোভাযাত্রা করে তাঁরা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এসব কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সফিকুল বাহার মজুমদার টিপু, কমান্ডার মোশারফ হোসেন, কমান্ডার আবুল বাসার, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নয়ন প্রমুখ।
বিজয় দিবসে বিজয় সাইকেল র্যালি: নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য, পরিবেশ রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে শক্তিশালী সাইকেল নেটওয়ার্ক তৈরির দাবিতে বিজয় দিবসে বিজয় সাইকেল র্যালি করেছে পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন মুভমেন্ট, বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট সাইক্লিস্ট। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। বক্তব্য দেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ও পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান। সভাপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট সাইক্লিস্টের সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম টুববুস।
স্কলাসটিকায় বিজয়মেলা: বিজয় দিবস উপলক্ষে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল স্কলাসটিকায় বিজয়মেলা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণীতে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক রোকেয়া সুলতানা। এ ছাড়াও বক্তব্য দেন স্কুলের অধ্যক্ষ ফারাহ সোফিয়া আহমেদ ও শিক্ষা কার্যক্রমের প্রধান সাবিনা মুস্তফা।
বনানী বিদ্যানিকেতন যেন বিজয়মঞ্চ: উত্তরায়ণ একাডেমি ও বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মহান বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণীর মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠানমালা শেষ হয়। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ প্রিয়াঙ্কা হালদার শিখা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উত্তরায়ণ একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী লিলি ইসলাম।
মন্তব্য করুন