- বাংলাদেশ
- কম দামি পণ্যে ক্রেতার চোখ
কম দামি পণ্যে ক্রেতার চোখ

ছুটির দিনের পড়ন্ত বিকেল। রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের এক মুদি দোকানে সদাই নিতে এলেন গৃহিণী পারভীন বেগম। দোকানির কাছে চাইলেন দুই কেজির প্যাকেটজাত ময়দা। ১৬৮ টাকা দাম শুনে হতভম্ব পারভীন জিহ্বায় বসালেন কামড়! পরে ১৪০ টাকায় দুই কেজি খোলা ময়দা কিনে হাঁটলেন বাসার পথে। যাওয়ার পথে বললেন, 'এক কেজি ময়দা ৮৪ টাকা! গরিব মানুষ বাঁচবে ক্যামনে।' তিনি আরও বলেন, 'আমরা একেবারে দরিদ্র, তা তো নয়। স্বামী বেসরকারি কোম্পানিতে ভালো চাকরি করেন। ৫০ হাজার টাকার মতো মাইনে পান। এক বছর আগেও এ টাকায় সংসারের সব খরচ বাদ দিয়ে কিছুটা সঞ্চয় হতো। এখন সংসারই চলে না, সঞ্চয় তো বহুদূর! এই যে দ্যাখেন, প্যাকেট ময়দা না কিনে কিছুটা কম দামের খোলাটা নিলাম। না খেয়ে তো থাকা যাবে না।'
খরচা কমাতে নিত্যপণ্যের ধরনে বদল এনেছেন মগবাজারের কামাল আহমেদ। গতকাল কারওয়ান বাজারের চালের আড়তে কথা হয় এই বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আগে ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজি দরের মিনিকেট কিনতাম। এখন একই দামে কিনতে হচ্ছে বিআর-২৮ কিংবা পায়জাম জাতের মোটা চাল। একইভাবে ১৪০ টাকার ছোট দানার মসুর ডাল বাদ দিয়ে কিনেছি ১১০ টাকা দামের বড় দানার ডাল।'
বড় মাছ কিংবা গরুর মাংস থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছেন পরীবাগের আবু তালহা। হাতিরপুল বাজার থেকে প্রতি কেজি ১৯০ টাকা দরে এক কেজি তেলাপিয়া মাছ কেনার পর তিনি বললেন, 'গেল ছয় মাসে একবারও গরুর মাংসের দোকানে যাইনি। মাঝে মাঝে ব্রয়লার মুরগি কেনা হয়। দাম বাড়ার পর রুই-কাতলা কেনাও বন্ধ। তেলাপিয়া আর ছোট জাতের মাছ কিনি এখন। তেলাপিয়া আগে ১২০ থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে কেনা যেত, এখন কেনা লাগে ১৯০ টাকায়।'
পারভীন, কামাল ও তালহার মতো সব ক্রেতারই বাজারে ঢুকে এখন হাঁসফাঁস অবস্থা। নিত্যপণ্যের দরদামের স্বস্তির কোনো বার্তা নেই। দাম ছুটছে তো ছুটছেই। এমন পরিস্থিতিতে বড় বিপদে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। কেউ কেউ এতদিন খাবারের পরিমাণ কমালেও এখন তাঁদের চোখ তুলনামূলক কম দামের পণ্যে।
কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ীও জানিয়েছেন, ক্রেতারা এখন কম দামের জিনিসই বেশি চাইছেন। তাঁদের আগের চেয়ে বিক্রিও কমেছে। মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের আলম স্টোরের বিক্রয়কর্মী মো. রাসেল বলেন, 'আগের মতো বেশি দামের জিনিস চান না ক্রেতারা। দরকষাকষিও করেন বেশি। এ কারণে বিক্রিও কমে গেছে।'
চাল, আটা, ময়দা, চিনি- এ চার নিত্যপণ্যের দাম ভোক্তাদের ভোগাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে চিনির সরবরাহ নেই বললেই চলে। ময়দার দাম এক সপ্তাহে আরেক দফা বেড়েছে। আর আগে থেকেই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে আটা ও চাল।
প্যাকেটজাত ময়দার দাম গেল সপ্তাহে আরেক দফা বেড়েছে। এতদিন প্যাকটজাত ময়দার কেজি ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন কিনতে হচ্ছে ৮২ থেকে ৮৫ টাকায়। সেই হিসাবে কেজিতে দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা। আর খোলা ময়দার কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে।
গত দেড় মাসে আটার দাম বেড়েছে তিনবার। মাসখানেক আগে বাজারে আটার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। যদিও দাম বাড়ার পর সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসে। এখনও চালের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে আটা। প্রতি কেজি খোলা আটা ৬০ থেকে ৬৫ এবং প্যাকেটজাত আটা ৭৪ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
দুই মাস ধরে বাজারে চিনির সংকট চলছেই। বেশিরভাগ জায়গায় চিনি মিলছে না। কিছু জায়গায় খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। তেজকুনীপাড়া এলাকার মাঈনউদ্দিন ট্রেডার্সের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, প্যাকেট চিনি নাই। হঠাৎ কোনো কোম্পানি চিনির প্যাকেট দিলেও সঙ্গে চা পাতা বা অন্য কিছু কেনার শর্ত জুড়ে দেয়।
নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় আমন ধান কাটা। পাশাপাশি বাড়ানো হয় চাল আমদানিতে শুল্ক্ক প্রত্যাহারের সময়সীমাও। এসবের সুফল দেখা যায়নি চালের বাজারে। গত এক মাসে প্রধান খাদ্যশস্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, এক মাসে সরু চালে ২ শতাংশের বেশি মাঝারি চালের প্রায় ৩ শতাংশ এবং মোট চালে ৫ শতাংশের বেশি দাম বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে এই হার আরও বেশি। এ সময়ে চিকন, মাঝারি ও মোটা চালে দাম বেড়েছে যথাক্রমে প্রায় ৯, ১০ ও ১১ শতাংশ হারে। অন্যদিকে এক মাসে খোলা আটা আড়াই শতাংশ, প্যাকেট আটা ৭ শতাংশ এবং প্যাকেট ময়দার দাম ৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। আর এক বছরের খোলা আটার ৭৩, প্যাকেট আটার ৭০, খোলা ময়দার প্রায় ৫৩ এবং প্যাকেট ময়দার ৫৭ শতাংশ দাম বেড়েছে। আর এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ।
তবে চাল, আটা, ময়দা ও চিনির দামের বাড়াবাড়ির মধ্যে ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও সবজির বাজারে কিছুটা স্বস্তির বাতাস বইছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা, সোনালি জাতের মুরগি ২৫০ থেকে ২৬০ এবং ডিমের ডজন ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে রয়েছে ভরপুর শীতের সবজি। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে শিম, মুলা, নতুন আলু, বেগুনসহ কয়েকটি সবজিতে দাম কমেছে কেজিতে ৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। নতুন আলুর দাম ধাপে ধাপে কমে এখন কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। তবে আগের বাড়তি দর এখনও রয়েছে টমেটোতে। প্রতি কেজি টমেটো কিনতে খরচ করতে হবে ১০০ থেকে ১১০ টাকা। বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে শসাও। এর কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে। এদিকে আগামীকাল রোববার থেকে বাজারে মিলবে নতুন দরের সয়াবিন তেল। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৯২ থেকে পাঁচ টাকা কমে ১৮৭ টাকায় বিক্রি হবে। আর খোলা সয়াবিন পাওয়া যাবে ১৬৭ টাকা দরে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় এখন মধ্যবিত্তরা বাধ্য হয়ে তুলনামূলক কম দামের পণ্য কিনছেন। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং ওএমএস ও টিসিবির পরিধি বাড়ানো। পাশাপাশি দেশে উৎপাদন বাড়াতে কৃষি পর্যায়ে ভর্তুকি দিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আমদানি ও বিক্রয় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হবে।
মন্তব্য করুন