গ্রামের ঘরে ঘরে পাকা আমনের মৌতাত। চারদিকে ধানের ভালো ফলনের শুভবার্তা। কৃষিসংশ্নিষ্টরাও দাবি করছেন, এবার আমনের উৎপাদন টেক্কা দিয়েছে সব রেকর্ড। তবু ধান-চাল সংগ্রহে খাবি খাচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। দেশজুড়ে সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে তাও এক মাস ছুঁয়েছে। অথচ গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারের ভাণ্ডারে এসেছে মাত্র ২৯ টন ধান আর ২৯ হাজার ৭৯০ টন চাল। এ পটভূমিতে প্রশ্ন উঠেছে- এত ধান, এত চাল গেল কোথায়?

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) জানিয়েছে, এবার আমন মৌসুমে ধানের আবাদ হয়েছে ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮৬ হাজার টন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) জানিয়েছে, ২০২২ সালে আমনের ফলন হয়েছে হেক্টরপ্রতি ২ দশমিক ৭৬ টন, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৭ শতাংশ বেশি। সে হিসাবে এ বছর আমনে প্রায় ১ কোটি ৬৩ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে।

চাষি ও মিলাররা বলছেন, সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম অনেক বেশি। এ কারণে সরকারের কাছে ধান বিক্রিতে উৎসাহ হারিয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া সরকারি গুদামে ধান বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতা থাকায় কৃষকরা স্থানীয় বাজারেই বেচে দেন। ফলে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা এবারও পূরণ না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

আবার কেউ কেউ বলছেন, চালকল মালিকরা কারসাজি করছেন। দাম বাড়ানোর চাপে রাখতে সরকারের গুদামে চাল দিচ্ছেন না তাঁরা। তবে কারসাজির সঙ্গে জড়িত চালকলগুলোর জামানত বাজেয়াপ্তসহ কালো তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর।

বিশ্নেষকরা বলছেন, ধান-চালের অভ্যন্তরীণ মজুত না বাড়ালে আপৎকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও রাষ্ট্রীয় সংগ্রহ পরিকল্পনা সফল করতে জোর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ তাঁদের।

ধান সংগ্রহ তলানিতে, চালের চুক্তিতে অনীহা :প্রতিবার ধানের মৌসুম এলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সংগ্রহ অভিযানে নামে। এই সংগ্রহ অভিযানের উদ্দেশ্য- সরাসরি কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো। অন্যদিকে দেশের রাইস মিলগুলো থেকেও সরকার চাল কেনে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে রাইস মিলগুলো।

চুক্তি অনুযায়ী সরকারের খাদ্যগুদামে মিলগুলো চাল সরবরাহ করে। সরকার প্রয়োজনের সময় এই চাল খোলাবাজারে বিক্রি করে।

এবার ১৭ নভেম্বর থেকে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধান-চাল সংগ্রহের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রেক্ষাপটে ৫ লাখ টন চাল ও ৩ লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। প্রতি কেজি চাল কেনা হচ্ছে ৪২ টাকা আর ধান ২৮ টাকায়। তবে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ২৯ টন ধান ও ২৯ হাজার ৭৯০ টন চাল সংগ্রহ হয়েছে।

গত ১৭ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মিলারদের সঙ্গে চুক্তি করার সময় নির্ধারিত ছিল। তবে আশানুরূপ চুক্তি না হওয়ায় সময় বাড়িয়ে ১৫ ডিসেম্বর করা হয়। এরপরও কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া গেছে কিনা, সে তথ্য গতকাল শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত জানাতে পারেনি খাদ্য মন্ত্রণালয়। গত সোমবার পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ৫ হাজার ৫৮৯ জন মিলার চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এরা সরকারকে দেবে ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮০১ টন চাল। এ সংখ্যা মোট মিলারের ৫৫ শতাংশ। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিলারদের দাবির মুখে ২ শতাংশ উৎসে কর প্রত্যাহার করার পর থেকে চুক্তির প্রবণতা বেড়ে যায়।

আগ্রহ নেই কৃষকের: গত সোমবার মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার ধূল্যা গ্রামে সরেজমিন গিয়ে কৃষক আব্দুল মোতালেবের সঙ্গে কথা হয়। ধানের দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, 'এই হিসাব অত সহজ না। এই ধরেন গিয়া যদি আমি নিজের জমি নিজে চাষ করি, তা হইলে হিসাব এক রকম। আর যদি অন্যের জমি বর্গা নেই, তা হইলে খরচ আরও বেশি।'

আরেক কৃষক রহমান আলী বলেন, 'এবার জমিতে সেচের পানি, সার, বীজ, কীটনাশক, যন্ত্র ও ধান কাটার খরচ বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। জমি বর্গা নিয়ে এক কৃষকের এক কেজি ধানের উৎপাদন খরচ আসে ৩০ টাকা ৭১ পয়সা। আর নিজের জমি হলে আসে ২০ টাকা। অথচ সরকার দিচ্ছে মাত্র ২৮ টাকা। এতে কৃষকরা সরকারকে ধান না দিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। আর একশ্রেণির মুনাফালোভী মিলার কৃষকদের লোভ দেখিয়ে সরকারি দরের চেয়ে সামান্য বেশি দাম দিয়ে কিনে গুদামজাত করছে।'

নোয়াখালী সুবর্ণচরের চরবাটা ইউনিয়নের ভূঁইয়ার হাটের কৃষক দুলাল চন্দ্র দাস বলেন, 'অ্যাপসের মাধ্যমে ধান বেচতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। অ্যাপস আমরা বুঝি না। খোলাবাজার থেকে কম দামে সরকার ধান কিনছে। সরকারের কাছে ধান বেচে লাভ কী?'

অন্যদিকে ধান বিক্রির পর কৃষকের ব্যাংক হিসাবে দেওয়া হয় টাকা। এ ধরনের ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেই অনেক কৃষক সরকারকে ধান দেন না। ক্রয়কেন্দ্রে কর্মকর্তার মনের মতো শুকনো ধান কৃষক সবসময় আনতে পারেন না। ধান নিয়ে এসে ক্রয়কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের আর্দ্রতা পরীক্ষায় পাস করাতে না পারলে ঝামেলায় পড়তে হয়।

খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ধানের ৪৭ শতাংশ উৎপাদন করেন ক্ষুদ্র চাষিরা। ৩৩ শতাংশ চাষি নগদ টাকায় জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করেন আর ২৬ শতাংশ হচ্ছেন ভাগচাষি। ধানের দাম কম হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এই তিন ধরনের চাষি। তাঁরা মূলত ঋণ কিংবা পারিবারিক টাকা বিনিয়োগ করে ধান চাষ করেন। এরপর উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ধান বেচে ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

মধু খান মিলাররা: চুক্তি না মানলে মিলের লাইসেন্স স্থগিত, জামানত বাজেয়াপ্তের মতো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় বলে বেশিরভাগ মিলার সরকারের কাছে চাল বিক্রি করেন। এ কারণে ধান সংগ্রহে পিছিয়ে থাকলেও চাল সংগ্রহ প্রতি বছর ভালোই হয়।

'বাংলাদেশে চালের দাম বৃদ্ধির একটি সমীক্ষা: কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ের অবস্থা' শীর্ষক বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে ধান-চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে পাঁচবার হাতবদল হয়। প্রতিবার হাতবদলের সময় যোগ হয় খরচ আর মুনাফা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ও অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন চালকল মালিকরা। তাঁরা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে ৮ থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করছেন।

ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, অতিমুনাফার লোভে মৌসুমি ব্যবসায়ী কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে গুদামে মজুত করেছেন। এই ধান সিন্ডিকেট করে মিলারদের কাছে বিক্রি করছেন বাড়তি দরে। পাশাপাশি করপোরেট হাউসগুলো বাড়তি দামে প্যাকেটজাত চাল বিক্রির উদ্দেশ্যে ধান মজুত করছে। এ কারণে মিল পর্যায়ে চাল উৎপাদনে দাম বেড়ে যাচ্ছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকারি গুদামে পৌঁছে দিয়ে ধান বিক্রি করে কৃষক তেমন লাভ করতে পারছেন না। ফলে মিল মালিকদের নিয়োজিত ফড়িয়াদের কাছে বাড়িতে বসেই ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন তাঁরা।

তিনি বলেন, এ অবস্থায় মিল মালিকরা এক টাকা বেশি দামে ধান কিনে সরকারের কাছে তিন টাকা বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন। এতে দুই দিকে ক্ষতি হচ্ছে। যে চাল তাঁরা সরকারের গুদামে দিচ্ছেন, তা আর বাজারে আসছে না। ফলে বাজারে চাল সরবরাহে ভাটা পড়েছে। এতে চালের দাম আরও বাড়ছে।

উত্তরাঞ্চলের চালের অন্যতম বৃহৎ মোকাম রংপুরের মাহিগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক সমিতির সহসভাপতি রিপন চৌধুরী বলেন, খাদ্য বিভাগ ৪২ টাকা কেজি দরে চাল কিনবে, তবে বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি চাল ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় লোকসান দিয়ে চাল সরবরাহ করা সম্ভব নয়।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের চেয়ারম্যান মো. রশিদুল হাসান বলেন, সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রথমেই গুদামগুলোকে উন্নত করতে হবে। ভবিষ্যতে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে অটো রাইস মিলে বিনিয়োগ করতে হবে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, লাইসেন্স নেই- এমন অনেক ব্যক্তি ধান-চাল কিনে মজুত করে রাখছেন। এতে বাজারে ধান-চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়। বোরো মৌসুম থেকে ধান-চাল ব্যবসায়ীদের প্রতি সপ্তাহের রিটার্ন দাখিল করার নিয়ম চালু করা হয়েছে। অর্থাৎ যাঁরা ধানের আড়তের ব্যবসা করছেন, তাঁদেরকে প্রতি সপ্তাহে কতটুকু ধান কিনছেন, কতটুকু ধান কোন মিলে বিক্রি করছেন, এর হিসাব সরকারকে দিতে হবে। চালকল মালিকদেরও এই নিয়ম মেনে চলতে বলা হয়েছে। যাঁরা এই হিসাব দেবেন না, তাঁদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। এ ছাড়া যেসব মিলার করপোরেট গ্রুপের কোনো ব্র্যান্ডের নামে চাল বাজারজাত করার চেষ্টা করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।