
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর গত ১২ বছরে ৪৯টি মামলার রায় হয়েছে। এতে মৃত্যুদণ্ড, আমৃত্যু কারাদণ্ডসহ ১২৫ যুদ্ধাপরাধীর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৫৪ আসামির কোনো হদিস নেই। এই আসামিদের ধরতে আবারও প্রত্যেক জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, র্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে চিঠি দেওয়া এবং ট্রাইব্যুনালের ওয়েবসাইটে তাঁদের ছবিসহ বিস্তারিত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তদন্ত সংস্থা।
এ বিষয়ে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক সমকালকে বলেন, 'মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতকদের মধ্যে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ মনিটরিং সেল তৎপর। পলাতক সবার বিষয়ে আমরা আবারও ডিসি-এসপিদের চিঠি দেব।'
সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন এমন ৪১ আসামি পলাতক। আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া ১২ ও ২০ বছর সাজা পাওয়া একজন পলাতক রয়েছেন। বর্তমানে সাজাপ্রাপ্ত ৬২ আসামি দেশের বিভিন্ন কারাগারে। আর সাজা ঘোষণার পর অসুস্থ ও বার্ধক্যজনিত কারণে কারাগারে মারা গেছেন ৯ জন। দণ্ডাদেশ পাওয়া ৫৪ আসামি ছাড়াও ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলায় বর্তমানে ৮১ জন পলাতক। রায় ঘোষণার আগে কারা হেফাজতে ১৮ ও রায়ের আগে পলাতক অবস্থায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের ৪২তম রায়ে ৯ জনের মধ্যে একমাত্র আসামি খালাস পেয়েছেন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের আব্দুল লতিফ।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এরই মধ্যে আপিল নিষ্পত্তির পর সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে ছয় যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ১৯ মামলায় আরও ৩৪ জনের বিচার চলছে। ২০১৩ সালের ২১ মার্চ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে ফরিদপুরের জামায়াত নেতা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায় হয়। কিন্তু তিনি ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে প্রথমে ভারতে; পরে কানাডা যান বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে আমৃত্যু কারাদণ্ড রায় ঘোষণার এক বছর আগেই ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান রাজাকার কমান্ডার বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকন সুইডেনে পালিয়ে যান। একইভাবে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সাবেক এমপি ও জাতীয় পার্টির নেতা আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার ২০০৯ সালে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। পরে ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। দেশটির ফ্লোরিডায় সম্প্রতি আব্দুল জব্বারের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সাবেক শিক্ষামন্ত্রী বিএনপি নেতা ড. ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হলে তিনি সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারত পালিয়ে যান। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
তদন্ত সংস্থা বলছে, সাজা পাওয়া পলাতকদের ধরতে ২০১৯ সালের নভেম্বরে তাঁদের ঠিকানা অনুযায়ী ৩০ জেলা ও থানায় ছবিসহ চিঠি পাঠানো হয়। পাশাপাশি তাঁদের ধরতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। বিদেশ থেকে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল-সংশ্নিষ্টরা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলেই তাঁদের নজরদারিতে রাখার কথা বলছেন। অন্যদিকে পলাতকদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্তরিক নয় বলে অভিযোগ করেছেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত। তিনি সমকালকে বলেন, 'যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতকদের গ্রেপ্তারে পুলিশ বাহিনীর যে তৎপরতা দরকার, তা বিদ্যমান আছে বা ছিল বলে কখনও মনে হয়নি। আমরা তো একাধিক আসামিকে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ ও দাফন হওয়ার তথ্য পেয়েছি। নিজ বাড়িতে তাঁরা কীভাবে পলাতক ছিলেন, বিশাল প্রশ্ন রয়েই যায়।'
মৃত্যুদণ্ড পাওয়াদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সৈয়দ হাছান আলী, শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই আসামি ফেনীর দাগনভূঁইয়ার আশরাফুজ্জামান খান ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চৌধুরী মঈনউদ্দিন, জামালপুরের যুদ্ধাপরাধী আব্দুল মান্নান, আশরাফ আলী ও আব্দুল বারি, শরীয়তপুরের ইদ্রিস আলী সরদার, হবিগঞ্জের লাখাইয়ের লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম প্রমুখ পলাতক রয়েছেন।
মন্তব্য করুন