স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ৬ মাসে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে পদ্মা নদী পারাপার হওয়া যানবাহনের সংখ্য অনেক কমেছে। এতে দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় নেই সেই চিরচেনা যানবাহনের দীর্ঘ সারি ও নদী পারের অপেক্ষায় আটকে থাকা হাজার হাজার মানুষ। তাই দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় বন্ধ হয়ে গেছে শত শত খাবার হোটেল, দোকানপার্ট ও নানা পণ্যের অসংখ্য হকারের পদচারণা। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন সহস্রাধিক মানুষ।

দীর্ঘদিন ধরেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার ছিল দৌলতদিয়া ঘাট। নানা ভোগান্তি থাকলেও এ নৌবন্দর ব্যবহার করে লাখ লাখ মানুষ যাতায়াত করতেন। তবে সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে অবস্থা পরিবর্তন হয়েছে এ ঘাটের। গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর অনেকটা কমে এসেছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের গুরুত্ব। যানবাহন ও যাত্রীর সংখ্যা কমেছে কয়েক গুণ। দীর্ঘদিন ধরে দৌলতদিয়া ঘাটে এসে ফেরির নাগাল পাওয়া ছিল সোনার হরিণের মতো, আর বর্তমানে যানবাহনের জন্য প্রতিটি ফেরিকে অপেক্ষা করতে হয়। বাধ্য হয়ে নৌরুটের ফেরি বহরে থাকা প্রায় অর্ধেক ফেরি বসিয়ে রাখতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগে প্রতিদিন দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে সব মিলিয়ে ৬ থেকে ৮ হাজার যানবাহন পারাপার হলেও বর্তমানে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ যানবাহন পারাপার হয়।

স্বাভাবিক কারণেই লঞ্চ বা ফেরিতে নদী পারের জন্য অপেক্ষমান মানুষের প্রয়োজনে দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় অন্তত ২ কিলোমিটারজুড়ে মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠেছিল শত শত দোকানপার্ট ও খাবার হোটেল। এসব ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৮০ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। আটকে থাকা যাত্রীদের ওপর ভিত্তি করে ঘাট এলাকায় ছিল নানা পণ্যের শত শত হকার। বর্তমানে ক্রেতার অভাবে তাঁদের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া পরিবহন সেক্টরে ঘাট এলাকায় কয়েকশ শ্রমিক কাজ করতেন। এখন যানবাহন কমে যাওয়ায় এসব শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মাপাড়ে কৃষি ক্ষেতে কাজ করছেন অসংখ্য নারী শ্রমিক। হঠাৎ অচেনা মানুষ দেখে কয়েকজন নারী শ্রমিক মুখ লুকানোর চেষ্টা করেন। সাংবাদিক পরিচয় দিলে তাঁরা ছবি না তোলার অনুরোধ করেন। ছবি না তোলার নিশ্চয়তা দিলে ফরিদা বেগম নামে একজন বলেন, 'আমরা পেটের দায়ে আজ কৃষি ক্ষেতে পড়েত (কৃষি ক্ষেতের শ্রমিক) দিতে নেমেছি। নদীভাঙনে কয়েক বছর আগে সর্বস্ব নদীতে চলে যায়। তার পরও দৌলতদিয়া ঘাটে বাড়ির পুরুষরা কাজ করে ভালোই আয় করত। তাতে ভালোভাবেই চলে যেত। আর আমাদেরও ঘরের কাজ ছাড়া কিছু করতে হতো না। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর ঘরের পুরুষ মানুষ কর্মহীন হয়ে আয়রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। দু'বেলা খাওয়ার জন্য এখন পড়েত দিচ্ছি।' এ এলাকায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে হয়তো তাঁর স্বামী কাজ পেতেন অথবা তিনিও সেখানে সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারতেন বলে জানান।

ঘাট এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, যানবাহন চলাচল কমে যাওয়ায় এখন দৌলতদিয়া ঘাট অনেকটাই যাত্রীশূন্য হয়ে গেছে। এতে করে তাঁদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা পেশা পরিবর্তন করে নদীতে মাছ শিকারের কাজ করছেন। ঘাট শ্রমিক বাবলু মিয়া জানান, আগে দৌলতদিয়া দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার পরিবহন চলাচল করত। বর্তমানে ২০০ থেকে আড়াইশ পরিবহন যাতায়াত করে। তাই তাঁরা বেশিরভাগই বেকার হয়ে পড়েছেন।
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. সালাউদ্দিন জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবহারকারী যানবাহনের সংখ্যা অনেক কমেছে। এ রুটে নদী পারাপারে ১৮টি ফেরি বরাদ্দ থাকলেও ১০টি ফেরি দিয়েই যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে।