- বাংলাদেশ
- কৃষিতে নারীর স্বীকৃতি ও বাজেটে বরাদ্দের তাগিদ
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
কৃষিতে নারীর স্বীকৃতি ও বাজেটে বরাদ্দের তাগিদ

সমকাল কার্যালয়ে মঙ্গলবার 'নারী কৃষকের অবস্থা :একটি জনবিশ্নেষণ' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রিত অতিথিরা সমকাল
বীজ সংরক্ষণ থেকে উৎপাদনের সব প্রক্রিয়ায় নারীর অবদান ৭০ ভাগ। বাকি অবদান পুরুষের। কৃষির প্রতিটি স্তরে অবদান রেখেও নারীরা থাকেন আড়ালে। বলা চলে, পুরুষ নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থায় তাঁরা অবহেলিত। মিলছে না কোনো স্বীকৃতি। এ অবস্থায় নারীসহ প্রকৃত কৃষক ও খামারিদের তালিকা করে প্রণোদনা, অবদানের স্বীকৃতি, সুদবিহীন ঋণ সহায়তার পাশাপাশি নীতি বাস্তবায়নে বাজেটে বরাদ্দের আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজন।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ের সভাকক্ষে 'নারী কৃষকের অবস্থা :একটি জনবিশ্নেষণ' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ আহ্বান জানান তাঁরা। যৌথভাবে এ আয়োজন করে সমকাল ও একশনএইড বাংলাদেশ।
সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেনের সভাপতিত্বে এবং সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান শেখ রোকনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম। আলোচক হিসেবে ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলাই কৃষ্ণ হাজরা, সাবেক সিনিয়র সচিব আনোয়ার ফারুক, একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ, কৃষি তথ্য বিশ্নেষক ও খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক-খানির সহসভাপতি রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা, নারী কৃষি উদ্যোক্তা কাকলী খান, কেন্দ্রীয় কৃষক মৈত্রীর সভাপতি মনির আহমেদ, খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সমন্বয়ক কানিজ ফাতেমা, একশনএইড বাংলাদেশের ওমেন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট সমন্বয়কারী শওকত আকবর ফকির, নারী কৃষক পটুয়াখালীর কলাপাড়ার তাহমিনা বেগম, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের রোজিনা বেগম, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রোকসানা বেগম প্রমুখ।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন একশনএইড বাংলাদেশের ডেপুটি ম্যানেজার অমিত রঞ্জন দে। তিনি বলেন, 'নারী কৃষকদের উৎপাদক হিসেবে বিবেচনা না করায় ভূমির অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। পারিবারিক কৃষিকাজে অংশ নিয়েও পাচ্ছেন না স্বীকৃতি। অথচ সরকারি তথ্যেই ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ গ্রামীণ নারী কৃষিকাজে জড়িত।'
প্রবন্ধে নারী ও ক্ষুদ্র কৃষকদের কৃষি প্রণোদনা-ভর্তুকি বৃদ্ধি, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, দুর্যোগকালীন কৃষক ও কৃষিপণ্যের বীমা চালু, বিভাগীয় ও উপজেলা পর্যায়ে নারীবান্ধব নিরাপদ খাদ্যের ডিপো নির্মাণ, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা সরেজমিন শিখনের ব্যবস্থা, মজুরি বৈষম্য দূর করাসহ আট দফা সুপারিশ করা হয়।
সায়েদুল ইসলাম বলেন, 'নারীর হাতে শুরু কৃষি, আর কৃষি দিয়েই শুরু হয়েছিল সভ্যতা।
আগের মতোই কৃষি এ দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। জিডিপিতে কৃষির অবদান ক্রমান্বয়ে কমলেও (১২ শতাংশ) শ্রমের ক্ষেত্রে এখনও ৪০ ভাগের ওপরে। এই যে শ্রমশিক্ত, সেখানেও কিন্তু নারীর অংশগ্রহণ বেশি। কৃষি উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতি। ফলে নারী ও বাংলাদেশের অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ অবস্থায় নারী কৃষকের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।'
সভাপতির বক্তব্যে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, 'কৃষির উদ্ভব নারীর কাছ থেকে। পুরুষরা যখন প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ফলফলাদি, পশুপাখি সংগ্রহ করত, তখন সন্তান ধারণের জন্যই নারীর অবস্থান ছিল গৃহকেন্দ্রিক। তখন সে লক্ষ্য করে, বীজ পড়ে থাকলে অঙ্কুরোদ্গম বা চারা উৎপন্ন হয়। আর এটিই সম্ভবত কৃষির প্রথম উদ্ভব। তবে শুরু থেকেই কৃষির প্রতিটি স্তরে অবদান রেখে এলেও নারীরা আড়ালেই থাকে।'
বলাই কৃষ্ণ হাজরা বলেন, 'প্রতিটি জেলায় কৃষিমেলার উদ্যোগ নেওয়া হবে। যে আয়োজনে থাকবে ব্যাংকার, কৃষি উদ্যোক্তা, কৃষক ও গণমাধ্যমকর্মী। কৃষককে সহজে ঋণ দিতেই এ উদ্যোগ।'
আনোয়ার ফারুক বলেন, 'বাবার সম্পদ থেকে বোনের অংশ না দিতে নানা টালবাহানা হয়। গ্রামীণ জমির মতো শহরের সম্পদেও বোনকে অংশ দিতে ভাইদের মানসিকতায় পরিবর্তন জরুরি।' ফারাহ্ কবির বলেন, 'বাজার ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে একশনএইড বাংলাদেশ কাজ করছে। যদিও পুরুষতান্ত্রিকতায় নারীদের এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নারী কৃষককে বসার স্থান, ছাউনি ও শৌচাগারের সংকটে পড়তে হচ্ছে। এ জন্য সচেতনতা বাড়াতে দেশব্যাপী ক্যাম্পেইন করতে হবে।'
অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, 'বাজার ব্যবস্থায় আমরা অনেক দুর্বল। ইনপুট-আউটপুট দুই ধরনের মার্কেটিংয়েই। কিষানিদের অবস্থা এ ক্ষেত্রে আরও ভয়ানক।'
কাকলী খান বলেন, 'নারীরা যে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করেন, ঢাকা শহরে তা সংরক্ষণে ডিপো নেই। তেমন বাজারও গড়ে ওঠেনি।' কানিজ ফাতেমা বলেন, 'ফসল উৎপাদনের সঙ্গে গবাদি পশু, মৎস্য চাষ, সামাজিক বনায়নও জড়িত। আমরা যখন কৃষক, খামারি, মৎস্য ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করি অথবা বৃহৎ কৃষি উদ্যোক্তার কথা ভাবি, তখন কিন্তু নারীকে রাখি না। চিন্তার কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণেই কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণ, স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন অদৃশ্য।'
গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়, কৃষি খাতে ২১ ধরনের কাজের ১৭টিই নারীরা করেন। এর পরও স্বীকৃতির জায়গায় তাঁর অবদানকে প্রাত্যহিক কাজের অংশ মনে করা হয়। পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে নারী কৃষি শ্রমবাজারে গিয়ে ভয়াবহ মজুরির বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। একই ধরনের কাজে পুরুষ যেখানে ৭০০ টাকা পাচ্ছেন, নারীকে দেওয়া হচ্ছে বড়জোর ৩০০ টাকা। এ বৈষম্য দূর না করলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না।
মন্তব্য করুন