সংবাদপত্র শিল্পে শুল্ক কর কমানোর প্রস্তাব নোয়াবের
এনবিআরের সঙ্গে প্রাক-বাজেট বৈঠক
.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:২২
সংবাদপত্র শিল্প বাঁচাতে আগামী বাজেটে নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাট কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। একই সঙ্গে এ খাতকে সেবামূলক শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে করপোরেট কর সর্বনিম্নে নির্ধারণ অথবা অবলোপন করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে গতকাল রোববার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট বৈঠকে নোয়াব এসব দাবি করে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। গতকাল ছিল আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের জন্য অংশীজনের সঙ্গে প্রথম বৈঠক।
বৈঠকে নোয়াবের পক্ষে প্রস্তাব তুলে ধরেন সংগঠনের সভাপতি এ. কে. আজাদ এমপি। তিনি বলেন, সংবাদপত্র শিল্প কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল মাধ্যমের বহিঃপ্রকাশ এবং টেলিভিশনের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি সংবাদপত্র শিল্পকে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে; অন্যদিকে বিভিন্ন শুষ্ক, ভ্যাট ও করপোরেট কর এ শিল্পের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক খাতে ১২ শতাংশ এবং কিছু ক্ষেত্রে আরও কম হলেও সংবাদপত্র শিল্পে সাড়ে ২৭ শতাংশ করপোরেট কর রয়েছে। নোয়াব সভাপতি আরও বলেন, বেশ কয়েক বছর সংবাদপত্র শিল্প বিকাশে বিভিন্ন প্রস্তাব বা প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলেও সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
এ. কে. আজাদ বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় বিশেষত ডলারের ক্রমবর্ধমান বিনিময় হার সংবাদপত্র শিল্পকে নতজানু করে ফেলেছে। কয়েক বছর, এমনকি অল্প কিছুদিন আগেও এক টন নিউজপ্রিন্টের মূল্য ছিল ৬০০ ডলারের নিচে। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭০০ ডলারের বেশি। এর অন্যতম প্রধান কারণ, টাকা ডলারের বিরূপ বিনিময় হার। ডলারের বিনিময় হার ১০৯ বা ১১০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বাস্তবে ১২৩ থেকে ১২৪ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, নিউজপ্রিন্টে আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ হলেও এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর, পরিবহন বীমা ইত্যাদিসহ ল্যান্ডেড ব্যয় প্রায় ৩০ শতাংশে দাঁড়ায়। সংবাদপত্রকে সরকার সেবাশিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছে। সাংবাদিক ছাড়াও মুদ্রণ, বিপণন, বিতরণ ও বিজ্ঞাপন ইত্যাদিতে অগণিত মানুষ এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এর অব্যাহত অগ্রগতি ও পরিচালনার জন্য শুষ্ক ও করনীতি প্রয়োগে বিপুল সংস্কার তথা সহায়ক ভূমিকা প্রয়োজন। সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য প্রকাশ ও রাজস্ব বাড়াতে অংশীজন হিসেবে সরকারকে সহায়তা করছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখে আরও বিকাশে শুল্ক কর কমানো দরকার।
বৈঠকে উপস্থাপিত নোয়াবের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে– নিউজপ্রিন্টের আমদানি শুল্ক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা, ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং সংবাদপত্র শিল্পকে সেবামূলক শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে করপোরেট কর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নির্ধারণ করা অথবা অবলোপন করা।
বৈঠকে ডেইলি স্টার সম্পাদক ও নোয়াবের নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহ্ফুজ আনাম বলেন, প্রতিবছর বাজেটের আগে এ শিল্পের জন্য যৌক্তিক কিছু প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হয় না। নোয়াবের কোনো দাবিই গ্রহণ করা হচ্ছে না। সরকারকে বেশি কর আহরণ করতে হবে ঠিক আছে, তার পরও তো বিভিন্ন শিল্পে সহায়তা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমান করপোরেট কর সংবাদপত্র শিল্পে থাকা বোধগম্য নয়; কোনোভাবেই সমান হওয়া উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে এনবিআর চেয়ারম্যানের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি অযৌক্তিক কোনো দাবি নয়; বরং ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশের সমতুল্য কর প্রয়োগ করার আহ্বান জানান।
মাহ্ফুজ আনাম আরও বলেন, বাংলাদেশের মোট মিডিয়া বিজ্ঞাপন বাবদ বাজেটের প্রায় ৮০ শতাংশ ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও গুগল নিয়ে যায়। এতদিন এসব প্রতিষ্ঠান সরকারকে কোনো রাজস্ব দিত না। সম্প্রতি এনবিআরের উদ্যোগে কিছু রাজস্ব আসছে। গুগলসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গণমাধ্যমের অনেক কনটেন্ট ব্যবহার করে। কনটেন্টের ওপর কপিরাইট মূল্য অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ নিতে শুরু করেছে। এটি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে সরকারের পাশাপাশি সংবাদপত্র শিল্পের রাজস্ব শেয়ারিং বাড়বে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল মাধ্যমের নিজস্ব অফিস স্থাপন নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন বণিক বার্তা সম্পাদক নোয়াবের নির্বাহী কমিটির সদস্য দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, এটি সম্ভব হলে ওই সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দরকষাকষি করে রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব।
সভাপতির বক্তব্যে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, কোনো খাতকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলে এর অপব্যবহারের জন্য অনেকেই বসে থাকেন। নিউজপ্রিন্টে আমদানি শুল্ক কমানো হলে তখন সব কাগজই নিউজপ্রিন্টের আড়ালে দেশে আসবে। এ রকম অতীতে হয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই দেখেশুনেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে এবার নোয়াব মাত্র তিনটি প্রস্তাব দিয়েছে। এনবিআর এগুলো ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। বিশেষ করে এ খাতকে সেবামূলক শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে কিছু করা যায় কিনা, দেখা হবে। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব হারানোর হিসাবও পর্যালোচনা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে রাজস্ব বাড়াতে হবে। কর দিতে সক্ষম মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে সবাইকে করের আওতায় আনা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, খুব বেশিদিন আগে ব্যক্তি পর্যায়ে কর দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়নি। ধরে নেওয়া হয়, শিল্পপতি বা বেশি টাকার মালিকরাই শুধু কর দেবেন। তবে এর পরও এবার বেশ ভালো সংখ্যক করদাতা বেড়েছে। ২০২০ সালের জুনে ব্যক্তি পর্যায়ে করদাতার সংখ্যা ছিল ২১ লাখ। এবার তা ৩৮ লাখে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বৈঠকে এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস নীতি) মাসুদ সাদিক, সদস্য (ভ্যাট নীতি) জাকিয়া সুলতানা, সদস্য (কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।