সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকানো ও মানবিক সহায়তার প্রস্তুতি
মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠক

ফাইল ছবি
তাসনিম মহসিন
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:৩২ | আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১০:৩০
মিয়ানমারের রাখাইনে বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে একের পর এক লড়াইয়ে এলাকা হারাচ্ছে দেশটির জান্তা সরকার। আরাকান আর্মির চাপে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) বেশ কয়েকজন সদস্যকে। বর্তমান বাস্তবতায় সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা রাজ্যের নানা জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশেও আসতে চাইছে। এ অবস্থায় দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় আসা কয়েকশ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিতে বাংলাদেশকে অনানুষ্ঠিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে মিয়ানমার থেকে নতুন করে অনুপ্রবেশ করতে না দেওয়ার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা।
তবে সেখানে যদি বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটে, সেজন্য মানবিক সহায়তার প্রস্তুতিও রাখা হচ্ছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের (এনটিএফ) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সভাপতিত্বে বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। এতে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক সূত্র জানায়, রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত অব্যাহত থাকায় রোহিঙ্গারা বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বিশেষ করে, চলতি মাসের শুরু থেকে রোহিঙ্গারা এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকশ রোহিঙ্গা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের আশাপাশে রয়েছে। মানবিক বিবেচনায় প্রাণ বাঁচাতে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে এনটিএফ বৈঠকেও বিষয়টি তুলেছিল জাতিসংঘ। তবে ঢাকার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থানও বৈঠকে তুলে ধরা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, নতুন অনুপ্রবেশের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার। আমরা দীর্ঘদিন ধরে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছি। তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। এ অবস্থায় নতুন করে আর কাউকে বাংলাদেশে আশ্রয় বা প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশে আর কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়া হলেও যদি বড় কোনো বিপর্যয় ঘটে, সে পরিস্থিতিতে মানবিক সহায়তার প্রস্তুতি রাখছে ঢাকা। কারণ বড় সংকট দেখা দিলে তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকবে না।
১৫ ফেব্রুয়ারি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী গণমাধ্যমে বলেন, পরিস্থিতি যেটাই হোক, দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় কখনও পিছপা হব না। সীমান্ত দিয়ে আর একজন মিয়ানমার নাগরিককেও অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
বৈঠক সূত্র জানায়, এনটিএফ জাতিসংঘের কাছে জানতে চেয়েছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সংস্থাটি এখন পর্যন্ত কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে, বর্তমান মিয়ানমারের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় এ মুহূর্তে প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। তবে এটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি অগ্রাধিকার।
বৈঠকে উপস্থিত জাতিসংঘ প্রতিনিধি জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাখাইনে কাজ করার মতো জাতিসংঘের জনবল নেই। তবে কিছু বেসরকারি এনজিও রাখাইনে মানবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আর ২০১৮ সালে প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা করা নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) মধ্যকার চুক্তিটি প্রতিবছর নবায়ন হয়ে আসছিল। তবে মিয়ানমারে জান্তা সরকার আসার পর সে চুক্তি আর নবায়ন হয়নি। তবে গত ডিসেম্বরে চুক্তিটি নবায়ন হয়েছে বলে এনটিএফকে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের ঢাকার এক সংস্থাপ্রধান নাম না প্রকাশের শর্তে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি নিয়ে সমকালকে বলেন, চুক্তিটি নিয়ে জাতিসংঘও কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল। একই সঙ্গে নবায়নও জরুরি। কারণ জান্তা সরকারের সঙ্গে চুক্তিটি করার অর্থ দাঁড়াবে সেই সরকারকে বৈধতা দেওয়া। আবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনকে উপযোগী করে তোলার জন্য জাতিসংঘের সেখানে কাজ করাটাও জরুরি। তবে চুক্তিটি নবায়ন হয়েছে এটি সুখবর।
বৈঠক সূত্র জানায়, কক্সবাজার ও ভাসানচরে ৭০ কোটি ডলার সহযোগিতা করতে চেয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ লক্ষ্যে এনটিএফ বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।
বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের সহযোগিতার জন্য বিশ্বব্যাংকের একটি তহবিল রয়েছে। সে তহবিল থেকে বিশ্বব্যাংক কক্সবাজার ও ভাসানচরের প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করবে। এ অর্থ সেখানকার রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের জন্য ব্যয় করা হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হবে, তা সম্পূর্ণ অনুদান। আর বাংলাদেশিদের জন্য ব্যয় করা অর্থ আসবে ঋণ আকারে।
কক্সবাজার ও ভাসানচরে কোন প্রকল্পগুলোতে অর্থ খরচ করা হবে– জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পগুলো সরকার থেকে ঠিক করে দেওয়া হবে। আর এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) কাজ করছে। আগামী এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের পর্ষদ সভায় প্রস্তাবটি উঠবে। ৭০ কোটি ডলার মধ্যে ৫০ শতাংশ অনুদান এবং ৫০ শতাংশ আসবে ঋণ আকারে।