ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

নাফ নদে রক্ষা শাহপরীর

নাফ নদে রক্ষা  শাহপরীর

নৌকায় চেপে শনিবার টেকনাফের নাফ নদের জেটিঘাটে এলো পাঁচ রোহিঙ্গা সমকাল

 সাহাদাত হোসেন পরশ, ঢাকা   আব্দুর রহমান, টেকনাফ  

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:৩৫

কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের কোলঘেঁষে বয়ে গেছে নাফ নদ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে ভাগ করেছে এটি। শাহপরীর ও এই নদের ওপারে মিয়ানমারের পাতনছা, নরবনিয়া, নুরুল্লা, হাসসুরাতসহ কয়েকটি জনপদ।

স্থানীয় জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা ৫২ বছর বয়সী আব্দুস সালাম। শাহপরীর ও নাফ ঘিরে এখানকার বাসিন্দাদের জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। নাফ ঘিরে যেমন রয়েছে সুখস্মৃতি, তেমনই আছে নানা কষ্টের দিনলিপিও। এবার নাফ শাহপরীর বাসিন্দাদের কাছে ভিন্নভাবে ধরা দিয়েছে। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এই ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, তিন দিন ধরে নাফের ওপার থেকে যেভাবে বিকট গোলার শব্দ পাচ্ছি, এর আগে কখনও এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি। রাতে কানের ওপর বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমাতে হয়। স্থলসীমানা হলে এতক্ষণ ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হতো। অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটত। নাফ আমাদের শাহপরীর মানুষকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। নদ পেরিয়ে ওপারের গোলা এখনও দ্বীপে এসে পড়েনি। তুমব্রু, ঘুমধুমের মতো স্থলসীমানা থাকলে জন্মভিটা না ছেড়ে উপায় ছিল না। 

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শাহপরীর ওপাশে মিয়ানমারের অভ্যন্তর থেকে ভারী গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। দ্বীপের ৩০ হাজার বাসিন্দাও তিন দিন ধরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন।

এদিকে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের জের ধরে শাহপরীর জেটিঘাটে গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা নারীসহ ৫ জন অনুপ্রবেশ করেছে। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে মিয়ানমারের একটি ছোট মাছ ধরার ডিঙি নৌকা দিয়ে নাফ নদ পার হয়ে জেটিঘাটে অবস্থান নেয়।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে বিজিবি। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনী যুদ্ধের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তারা এখানে চিকিৎসা নিতে আসে বলে জানা গেছে। বিজিবি সূত্র বলছে, তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।

জেটিঘাটের ঝুপড়ি দোকানদার মো. সেলিম জানান, মিয়ানমারের একটি ডিঙি নৌকা শাহপরীর দ্বীপের জেটিঘাটে এসে পৌঁছেন। এদের মধ্যে একজন গুলিবিদ্ধ নারীসহ পাঁচজন রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা নারীর শরীরে স্যালাইন টানানো অবস্থায় দেখা যায়।

স্থানীয় যুবক রুবেল বলেন, আমরা জেটিতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিলাম। এমন সময় একটি নৌকা জেটিতে পৌঁছে। নৌকার মাঝিসহ কয়েকজন লোক ছিল। শুনেছি, তারা নাকি চিকিৎসার উদ্দেশে এসেছেন।  নৌকায় একজনকে শুইয়ে থাকতে দেখা যায়। শুনেছি তিনি গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা নারী। পরে বিজিবি সেখানে পৌঁছে নৌকাটি ঘিরে রাখে। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, গুলিবিদ্ধ নারী মিয়ানমার নরবনিয়া এলাকার বাসিন্দা আহমদ উল্লাহর স্ত্রী সফুরা খাতুন। কক্সবাজারের টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করেন আহমদ উল্লাহর বড় বোন রমজান বেগম। তিনি ভাই-ভাবিদের বাংলাদেশে প্রবেশের খবরে গতকাল শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে আসেন। রমজান বেগম সাংবাদিকদের বলেন, আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সফুরা শুক্রবার সকালে মিয়ানমারে গুলিবিদ্ধ হয়। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়েছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য টেকনাফে আনা হলে নাফ নদে বিজিবির হাতে ধরা পড়ে।

বাংলাদেশের দক্ষিণের শেষ সীমান্ত এলাকায় কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ। এটি লাগোয়া প্রায় ৪ কিলোমিটার নাফ নদ। এই নদঘেঁষা মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও  জান্তা সরকারের মধ্যে সংঘর্ষের প্রভাব পড়ছে এপারে শাহপরীর দ্বীপে। তবে এই নাফ নদ এখনকার মানুষের ছায়া হয়ে আছে। শাহপরীর বাজারপাড়া, জালিয়াপাড়া, গোলাপাড়া ও মিস্ত্রিপাড়া ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।  দ্বীপের দারুস শরিয়া আল ইসলামিয়া বড় মাদ্রাসার খতিব মাওলানা এশপাক বলেন, ফজরের নামাজ  শেষ করে বাড়ি যাওয়ার পথে থেমে থেমে অনেক বড় মর্টার শেলের শব্দ পাওয়া যায়। রাত ৩টার দিকে  হেফজ খানার ছেলেদের ঘুম ভেঙে যায়। আমরা এখানে খুব ভয়ের মধ্যে থাকি। 

জেটিঘাট এলাকার মো. সিদ্দিক বলেন, গত দু’দিন ধরে মর্টার শেলের শব্দে সীমান্ত এলাকা কাঁপছে। যে বিকট শব্দ হয় মাঝে মাঝে মনে হয়, গুলি বা মর্টার শেল এখানে এসে পড়বে।  

ইয়াবা কারবারের কারণে ২০১৭ সাল থেকে নাফ নদে মাছ ধরার ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে। শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা সোনা মিয়া বলেন, মিয়ানমারে যুদ্ধের কারণে নাফ নদের মোহনা ও সমুদ্রে গিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে পারছে না। বড় দু-একটি নৌকা সমুদ্রে গেলেও অধিকাংশ মাঝিমাল্লা ঘরে বসে আছেন। মর্টার শেলের শব্দে এপারের সীমান্তবাসীদের বাড়িঘর কেঁপে উঠছে।
টেকনাফ-২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ সমকালকে বলেন, সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। সকালে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে  গোলাগুলির খবর শুনেছি। কোনো রোহিঙ্গাকে আমরা ঢুকতে দেব না।  

 

আরও পড়ুন

×