ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

আইন নেই, তবুও চলছে দণ্ডদান

আইন নেই, তবুও চলছে দণ্ডদান

ছবি-সমকাল

 ওয়াকিল আহমেদ হিরন

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৪ | ০০:১৮ | আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৪ | ০৯:২৮

দেশে বর্তমানে আদালত অবমাননা আইন আছে, নাকি নেই– এ প্রশ্ন উঠছে। আইনজীবীরা বলছেন, ২০১৩ সালের আইনটি হাইকোর্ট বাতিল করার পর তা আর কার্যকর নেই। তবে এ বিতর্কের মধ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে আদালত অবমাননার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে।  

এরই মধ্যে হাইকোর্টে বাতিল হওয়ার ১০ বছর পর আদালত অবমাননা আইনটি ফের বহাল চেয়েছে সরকার। গত বছরের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সিভিল পিটিশন (সিপি) দাখিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১০ মাসেও শুনানি হয়নি ওই আপিলের।   

এ নিয়ে দু’পক্ষের পৃথক মত রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সর্বোচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ১৯২৬ সালের পুরোনো আদালত অবমাননা আইন বলবৎ থাকবে এবং এই আইনেই আদালতে বিচারকাজ চলছে। অন্যদিকে আইনজীবীরা বলছেন, ২০১৩ সালের আইনটি হাইকোর্ট বাতিল করলেও রায়ে পুরোনো আইন সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। অতএব, এখন আদালত অবমাননার কোনো আইন আর বলবৎ নেই। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে হাইকোর্টে আদালত অবমাননার প্রায় ২০০  মামলা বিচারাধীন। প্রতি সপ্তাহে হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চে এসব মামলার শুনানি হয়ে থাকে। সাম্প্রতিককালে আদালত অবমাননার দায়ে বিচারক ও জনপ্রতিনিধিসহ বেশ কয়েকজনকে সাজা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। 

এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সমকালকে বলেন, হাইকোর্ট আদালত অবমাননা আইন বাতিল করলেও ওই রায় স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে আপিল করা হয়েছে। আপিল বিভাগের কোনো সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত ১৯২৬ সালের আইনটি বহাল থাকবে।

তবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, কিছু নাগরিককে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য আদালত অবমাননা আইন-২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেটা ওই বছরই বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। বর্তমানে ১৯২৬ সালের আইন দিয়ে বিচারকাজ চলছে।  

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, হাইকোর্ট ২০১৩ সালের আইনটি বাতিল করলেও রায়ে পুরোনো আইন বলবৎ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। অর্থাৎ, এখন দেশে কোনো আদালত অবমাননা আইন নেই,..নেই,...নেই। আদালত তাঁর নিজস্ব এখতিয়ারে সাজা দিচ্ছেন। 

তিনি বলেন, ১০০ বছর আগের এক পাতার যে আইনটা আছে, প্রকৃত অর্থে তা কোনো আইন নয়। কারণ, সেখানে আইনের কোনো সংজ্ঞা নেই। ওটা ঔপনিবেশিক। ওই আইন এখন মূল্যহীন, অকার্যকর। তাঁর মতে, আদালত অবমাননার ঘটনায় সাজা দেওয়ার প্রবণতা আগে ছিল না, এখন দেখা যাচ্ছে।     

উচ্চ আদালতের আদেশ-নির্দেশ অমান্য করায় সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের বিরুদ্ধে অবমাননার অভিযোগে রুল জারি করা হয়। হাইকোর্ট নিজস্ব এখতিয়ারে এসব রুল জারি করে সংশ্লিষ্টদের তলব করেন। এখানে আদেশ হয় কার্যত আদালতের ইচ্ছায়। আদালত অবমাননার অভিযোগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ কেন নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করে জবাব চান আদালত। কেউবা জবাব দেন, আবার কেউ আইনজীবীর মাধ্যমে ক্ষমা চাইলে তাঁকে সতর্ক করেও অব্যাহতি দেন আদালত। কেউ আবার আইনিভাবে মোকাবিলাও করেন।

গত বছরের অক্টোবরে কুমিল্লার সাবেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানাকে এক মাসের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। তবে ওই দিনই তাঁর সাজা স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। পরে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলে ওই বিচারককে সাজা থেকে অব্যাহতি দেন আপিল বিভাগ।

সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ার দায়ে গত অক্টোবরে দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমকে এক মাসের সাজা দেন ও ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন আপিল বিভাগ। এরই মধ্যে কারাগার থেকে সাজা খেটে বের হয়েছেন তিনি।

আদালত অবমাননার অভিযোগে গত ২২ নভেম্বর বিএনপি নেতা পাবনার হাবিবুর রহমান হাবিবকে পাঁচ মাসের সাজাসহ ২ হাজার টাকা জরিমানা দেন হাইকোর্ট। বর্তমানে তিনি সেই সাজা খাটছেন। 

সর্বোচ্চ আদালতে দুই বিচারপতির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন ও মিছিল সমাবেশ করায় বিএনপিদলীয় সাত আইনজীবীকে আদালত অবমাননার নোটিশ দিয়ে সম্প্রতি ব্যাখ্যা চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। বর্তমানে বিষয়টি আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্যের কারণে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। ভবিষ্যতে আর এ ধরনের বক্তব্য দেবেন না বলে নুর লিখিতভাবে হাইকোর্টে অঙ্গীকারনামা দাখিল করেন। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৩০ এপ্রিল দিন ধার্য রয়েছে।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করায় ২০১৪ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক (নিউ এজ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি) ডেভিড বার্গম্যানকে সাজা দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই ট্রাইব্যুনালের বিচার চলাকালীন সময়কে (কয়েক মিনিট) কারাদণ্ড হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়নি।

বাতিল এবং আপিল ব্রিটিশ আমলে ১৯২৬ সালে প্রণীত আইনটিতে দণ্ডের কথা উল্লেখ থাকলেও আদালত অবমাননার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ফলে দণ্ড দেওয়া ছিল আদালতের ‘ইচ্ছার’ বিষয়। 

ব্রিটিশ আমলের উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলাদেশের মতো ভারত ও পাকিস্তানেও একই আইন প্রচলিত ছিল। তবে ভারতে ১৯৭১ সালে এবং পাকিস্তানে ১৯৭৪ সালে এ বিষয়ে নতুন করে আইন প্রণয়ন করা হয়। 

আদালত অবমাননা বিষয়টিকে সুনির্দিষ্ট ও এর সীমারেখা নির্ধারণ করতে বাংলাদেশে ২০০৮ সালে প্রথমে অধ্যাদেশ এবং পরে ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে আইন পাস হয়। এতে আগের আইনটি রহিত হয়ে যায়। 

নতুন আইনে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে এর আটটি ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দুই আইনজীবী ২০১৩ সালের মার্চে হাইকোর্টে রিট করেন। শুনানি শেষে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রায়ে আদালত অবমাননা আইনটিকে সংবিধান পরিপন্থি, অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।

ওই সময় রায়ের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করে রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছিলেন, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের সকল নাগরিককে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ আইনে জনগণের নির্দিষ্ট একটা অংশকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে যা বৈষম্যমূলক। এ কারণে আদালত অবমাননা আইন ২০১৩ বাতিল করেছেন হাইকোর্ট।

ওই রায়ের ৯ বছর পর ২০২২ সালের নভেম্বরে ৩৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এর পর গত বছরের মে মসে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সিভিল পিটিশন দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এখনও এর শুনানি হয়নি।

 

আরও পড়ুন

×