অনলাইন সেবায় আগ্রহ নেই, মন্ত্রীর দপ্তরে ‘সমাধান’
অনলাইনে ৩৮ ধরনের সেবা গ্রহণের সুযোগ থাকলেও সেটি এখন ১৮টি

.
আবু সালেহ রনি
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪ | ০০:৩৮ | আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৪ | ০৬:৫৮
প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার সহধর্মিণী করিমুননেছার বয়স ৫৭ বছর। সকাল থেকে এক নাতিকে নিয়ে তিনি ঢাকায় সচিবালয়সংলগ্ন পরিবহন পুল ভবনের ছয়তলায় ঘুরছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর দপ্তরের সামনে। নাতিকে বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিশেষ ছাড়ের সুপারিশ নেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য। আরও ৫/৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্য এবং দর্শনার্থী রয়েছেন মন্ত্রীর অপেক্ষায়।
বেলা গড়িয়ে সাড়ে ১১টা। হঠাৎ মন্ত্রী এলেন এবং তাঁর দপ্তরে প্রবেশ করলেন। তখনই হুড়মুড় করে মন্ত্রীর দপ্তরে প্রবেশ করেন অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা ও দর্শনার্থীরা। ভেতরে গিয়ে বিস্মিত করিমুননেছা। অপর দরজা দিয়ে তাদের মতো আরও অন্তত ২০ জন প্রবেশ করেছেন মন্ত্রীর কক্ষে। মন্ত্রী চেয়ারে বসলেন; তাঁর সহায়ককর্মীরা চুপ থাকতে বললেন সবাইকে। মন্ত্রীর সামনে উপস্থাপনের জন্য আগতদের দরখাস্ত বা সংশ্লিষ্ট কাগজ চেয়ে নেন সহায়ককর্মীরা। এরপর কাগজে উল্লিখিত নাম ধরে ডাক দিয়ে তাদের বক্তব্য শুনে সমাধান দিতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। গত ১১ মার্চ সরেজমিন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা যায় এমন চিত্র।
ঢাকাসহ দেশের দূরদূরান্ত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা ও সংশ্লিষ্টদের এমন ভিড় প্রতি কার্যদিবসেই লেগে থাকে মন্ত্রণালয়ে। চাইলেই দেখা মেলে মন্ত্রীর। হাজারো সমস্যা মুক্তিযোদ্ধাদের; কারও নিজের বা বাবার নামে ভুল বা ঠিকানা ভুল, কারও পুরোটাই ভুল। নয়তো মুক্তিযোদ্ধার ভাতা এলাকা পরিবর্তন, কারও নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তির আবেদন, সন্তানসন্ততি বা পোষ্যদের চাকরির সুপারিশ, শিক্ষাবৃত্তি, বিদেশে চিকিৎসা, কেউ বা অনলাইনে নাম ওঠানো, কারও আবার ভাতা বন্ধের আদেশ বাতিলের আবেদন থাকে। জেনেবুঝে বা ভুল করেও নানা ধরনের আবেদন নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আসছেন তারা। নানা ইস্যুতে দালালদের খপ্পরেও পড়েন কেউ কেউ। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের ভোগান্তি কমাতে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট অনলাইনে ৩৮ ধরনের সেবা প্রদানের কার্যক্রম শুরু করেছে মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্তকরণ, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাপ্রাপ্তি, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও তথ্য সংশোধনসহ ৩৮ ধরনের সেবা ‘মাইগভ’ অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে পাওয়া যায়। আরও থাকছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পুস্তকপ্রাপ্তি, মুক্তিযুদ্ধের সাময়িক সনদ প্রদান, রেজিস্টার সংশোধন, চিকিৎসাসেবা দান স্কিমের আওতায় মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে চিকিৎসাসেবা প্রদান, পিআরএল এবং ল্যাম্পগ্রান্ট অনুমোদন, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী মুক্তিযোদ্ধা সন্তান স্কলারশিপ স্কিমের আওতায় ছাত্রবৃত্তি সেবাসহ অন্যান্য বিষয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সহায়তায় এই কার্যক্রম চালু করা হয়।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সময়ের পরিক্রমায় অনলাইন সেবা কার্যক্রম থমকে গেছে। প্রচার না থাকার পাশাপাশি অনলাইন সেবায় গতি না থাকায় ফের মন্ত্রণালয়মুখী হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ সংশ্লিষ্টরা। এ-সংক্রান্ত তথ্যাদি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট অনলাইন সেবা চালু হওয়ার পর থেকে গত ১২ মার্চ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৩১ জন এই সেবা গ্রহণ করেছেন, যাদের অধিকাংশই করোনাকালে (২০২০-২২) সেবা নিয়েছেন। এরপর গত দেড় বছরে এই সেবা গ্রহণের হার মুখ থুবড়ে পড়েছে। চাহিদা না থাকায় অনলাইন সেবা কার্যক্রমও সংকুচিত হয়েছে। আগে অনলাইনে ৩৮ ধরনের সেবা গ্রহণের সুযোগ থাকলেও সেটি এখন ১৮টি। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
প্রত্যয়ন লাগছে না
অনলাইন সেবাগুলোর মধ্যে বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চালু হওয়া ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) কার্যক্রমের ব্যবহার শতভাগ হচ্ছে। সমন্বিত তালিকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যাদি অন্তর্ভুক্তির পুরো বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সোনালী ব্যাংক এখন অনলাইনে এমআইএসের মাধ্যমে করে। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এমআইএসের তথ্যাদি দেখার পাশাপাশি যাচাইয়ের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবারের সদস্যদের যে কোনো বিষয়ে সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ের পৃথক প্রত্যয়নপত্র বা সনদ বা অন্য কোনো ধরনের কাগজপত্রের প্রয়োজন হচ্ছে না। এতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সংশ্লিষ্টদের ভোগান্তি নেই বললেই চলে। যদিও ভুলে ভরা গেজেট ও অন্যান্য নথিপত্রের কারণে এমআইএসে মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্তিসহ সার্ভার ডাউনের কারণে কখনও ভোগান্তি পোহাতে হয় মুক্তিযোদ্ধাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, নানা ধরনের ভুলের কারণে তাদের অনেকেই সরকারি স্বীকৃতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সমন্বিত তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য সংশ্লিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধার লাল মুক্তিবার্তা, ভারতীয় তালিকা ও গেজেট প্রয়োজন হয়। বর্তমানে এই সমন্বিত তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ২ হাজার ৫৪৮।
আছে ভোগান্তি
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জামুকার কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করে। এ পর্যন্ত জামুকার ৮৮টি সভা হয়েছে। গত আড়াই বছরে অনুষ্ঠিত ১৩টি সভার কার্যপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দুই শতাধিক নাম বা ঠিকানা-সংক্রান্ত গেজেট সংশোধনের আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে। সিলেটের বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরমান আলী জানান, তাঁর নাম ভুলবশত ‘কোরমান আলী’ নামে গেজেটভুক্ত হয়েছিল। এটি সংশোধনের জন্য তাঁকে প্রায় দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়। সংশোধিত গেজেট আসার পর তাতে বাবার নামে ভুল ধরা পড়ে। মূল নথিতে বাবার নামের তথ্য সঠিক থাকায় বিষয়টি ফের গেজেটের জন্য পাঠানো হয়েছে। এসব কারণে তাঁর তথ্যাদি এমআইএসে নথিভুক্ত হচ্ছে না। ভাতাও পাচ্ছেন না।
ঢাকার লালবাগের মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘গেজেট সংশোধনের বিষয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর তিনি নথিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখে দিয়েছেন। এরপরও ১০ মাসে সমস্যার সমাধান হয়নি। সেখানে অনলাইনে আবেদন করলে কী হতে পারে, সেটা কি আর বলার দরকার আছে?’
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য গত এক দশকে প্রধানমন্ত্রী যে লক্ষ্য নিয়েছেন, তাতে সাড়া অনেক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকঢোল পিটিয়ে অনেক সেবা চালু করলেও তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে না। মুক্তিযোদ্ধাদের ভোগান্তি অনেক। এখনও হাসপাতালে একটি কেবিন বেড পেতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। অথচ অনলাইন সিস্টেমেই এসব সমস্যার সমাধান করা যায়। এ জন্য সদিচ্ছা জরুরি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় তাঁর কাছে সমস্যা নিয়ে যাওয়া সহজ। কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় যারা রয়েছেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, তাদের মানসিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা নিগৃহীত হন। অনলাইনে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ দায়েরের সুযোগ থাকা উচিত। এর আলোকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।’
মন্ত্রণালয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স এখন ৬৫ বছরের বেশি। তারা অনলাইন সিস্টেমে অভ্যস্ত নন। এই অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে কেউ কেউ সন্তান বা অন্য কারও মাধ্যমে অনলাইনে সেবা নেন। তবে অধিকাংশ সেটাও নেন না। আমরা চাই, তাদের কষ্ট না হোক, অনলাইনে সেবা নিক।’ তাঁর মতে, অভ্যাসবশত মুক্তিযোদ্ধারা সমস্যা সামাধনের জন্য সরাসরি মন্ত্রণালয়ে চলে আসেন। কারণ, তাঁর এখানে (দপ্তর) আসা সহজ। তারা নিজেরা দেখেশুনে সরাসরি সমস্যার সমাধান পান বলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।’
তথ্যগত ভুলভ্রান্তির বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘ভুল নানাভাবে হচ্ছে। এটি অস্বীকার করা যাবে না। তবে সেই ভুলগুলো মন্ত্রণালয় বা জামুকার নজরে আনা হলে তা দ্রুতই সমাধান করা হয়। এ ক্ষেত্রে আইনি কিছু বিষয় আছে, অর্থাৎ ব্যক্তির পরিচয়-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় রয়েছে; যেগুলো উপজেলা পর্যায়ে তদন্তের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হয়। এগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত গেজেট সংশোধন হয় না। তাই কিছু ক্ষেত্রে সময় লাগছে।’