- বাংলাদেশ
- লোডশেডিং কমলেও বাড়বে পিডিবির লোকসান
লোডশেডিং কমলেও বাড়বে পিডিবির লোকসান
মার্চে আসছে আদানির বিদ্যুৎ

প্রতীকী ছবি
ভারতের শিল্প গ্রুপ আদানির বিদ্যুৎ আগামী মার্চে আমদানি শুরু হবে। এতে লোডশেডিং কিছুটা কমতে পারে, বাড়বে পিডিবির (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) লোকসান। ভারতের উচ্চ করপোরেট ট্যাক্স, কয়লার দাম ও পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় এই বিদ্যুতের দাম বেশি হবে। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বেশ কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ আমদানি করে। পিডিবি সূত্রমতে, ওই বিদ্যুতের চেয়ে তিন গুণ বেশি দামে আমদানি করতে হবে আদানির বিদ্যুৎ। আর কয়লাভিত্তিক পায়রা কেন্দ্রের বিদ্যুতের চেয়ে দাম দ্বিগুণ বেশি হবে।
৮৪.৬ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে এই কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৩৪৪ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা। বিদ্যুৎ জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইনে সমঝোতার মাধ্যমে এই বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর আদানির সঙ্গে ক্রয়চুক্তি সই করে পিডিবি।
ভারতের ঝাড়খন্ডের গড্ডা জেলায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ প্রায় শেষ করেছে আদানি গ্রুপ। সেখান থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ১০৬ কিলোমিটার ও বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে জাতীয় গ্রিড পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের কমিশনিং সম্পন্ন হয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করছে আদানি। এখন ২০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ আসছে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, আগামী মার্চ থেকে আদানির বিদ্যুৎ নেওয়া হবে। এই বিদ্যুৎ এলে ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। আগামী গরমে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে আদানির বিদ্যুৎ বড় ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেন, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর চেয়ে আদানির বিদ্যুৎ সস্তা হবে। আদানির বিদ্যুৎ এলে তেলভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন কমবে। পাশাপাশি গ্যাস সংকটে থাকা বিদ্যুতের যে ঘাটতি হয় তা থেকেও পরিত্রাণ মিলবে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বিদ্যুৎ ঘাটতি ও লোভোল্টেজ সমস্যার সমাধান হবে। ফলে এই বিদ্যুৎ আমদানি দেশের জন্য লাভজনক হবে বলে তিনি মনে করেন।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম অবশ্য দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি সমকালকে বলেন, চাহিদা না থাকায় প্রতিবছর সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা মাশুল দিচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে। এর মধ্যে আদানির বিদ্যুতের কোনো প্রয়োজন ছিল না। তিনি এই চুক্তি বাতিলের দাবি জানান।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ব্যবসায় জড়িত একাধিক উদ্যোক্তা সমকালকে বলেন, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ছাড়া বিনিয়োগের একটি বড় অংশ দেশেই ব্যয় হয়। যা অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে। যে এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়, সেই এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটে। নির্মাণকালে এবং উৎপাদনের যাওয়ার পর অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মতো একই রকম শর্তে আদানির বিদ্যুৎ কেনা হলেও তার সুফল ভোগ করবে ভারত। সে দেশের লোকজনের কর্মসংস্থান হবে। মেয়াদ শেষে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারতেই থেকে যাবে। অর্থাৎ আদানির বিদ্যুৎ কিনে বাংলাদেশের লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
চুক্তির দুর্বলতায় কয়লার খরচ বাড়াবে :এই বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে আদানি গ্রুপ ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ১৬৩ পৃষ্ঠার চুক্তিটি তিনজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে পর্যালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। গত ৯ ডিসেম্বর এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম যত বেশিই হোক না কেন, পিডিবি নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড় পায়। অথচ, আদানির সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী দিতে হবে। এতে জ্বালানি খরচ বেশি পড়বে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে পিডিবির একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, চুক্তি অনুসারে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি খরচ বিদ্যুতের মূল্যের সঙ্গে পরিশোধ করে পিডিবি। সাধারণত, কয়লার মূল্য নিউক্যাসল মূল্য সূচকের ভিত্তিতে গণনা করা হয়। যদি কোনো কোম্পানি উচ্চ মানের কয়লা বেশি পরিমাণে দীর্ঘমেয়াদে কেনে, তাহলে বাল্ক্ক মূল্যের ওপর ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পায়। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের চুক্তিতে এই ছাড়ের বিষয়টি উল্লেখ আছে। ফলে পিডিবি কয়লার হ্রাসকৃত দাম পরিশোধ করতে পারছে। কিন্তু আদানির চুক্তিতে এমন কোনো শর্ত নেই। ফলে আন্তর্জাতিক দরে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এতে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি গ্রুপ গড্ডা কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল খনির কয়লা ব্যবহার করবে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা কয়লা খালাস হবে ভারতের উড়িষ্যার ধামরায় অবস্থিত আদানির নিজস্ব বন্দরে। সেই বন্দর থেকে গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত ৭০০ কিলোমিটার রেলপথে কয়লা নেওয়া হবে। আইইইএফএর তথ্যমতে, আদানি ভারতে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালায় এগুলো অধিকাংশই সমুদ্রের কাছে, যাতে সড়ক অথবা রেলে কয়লা পরিবহনের খরচ কমানো যায়। কিন্তু গড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্দর থেকে বেশি দূরে হওয়ায় কয়লা পরিবহনে বাড়তি ব্যয় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে।
বিদ্যুতের দাম বেশি: আইইইএফএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানির প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুৎ ১৬-১৭ টাকায় কিনতে হবে বাংলাদেশকে। যদিও আমদানি করা কয়লা দিয়ে উৎপাদিত পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ৮-৯ টাকা।
পিডিবির নিজস্ব প্রতিবেদনেও দাম বেশির তথ্য পাওয়া যায়। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানির কেন্দ্র থেকে চলতি অর্থবছর (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ আমদানির সম্ভাব্য পরিমাণ ২৯৮ কোটি ৭০ লাখ ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা)। এজন্য ব্যয় হবে ৫ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে ১৭ টাকা ৮৭ পয়সা। এই দাম ভারত থেকে বর্তমানে আমদানি করা বিদ্যুতের গড় দামের প্রায় তিন গুণ। পিডিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছর ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দাম পড়ে ৬ টাকা ১১ পয়সা। চলতি অর্থবছর প্রতি ইউনিটের গড় দাম (আদানি ছাড়া) পড়বে ৬ টাকা ৪১ পয়সা।
পিডিবির লোকসান বাড়বে: ডলার সংকট ও অর্থের অভাবে বিদ্যুৎ কেনার বকেয়া বিল দিতে পারছে না পিডিবি। এরই মধ্যে আট মাসের বিল বকেয়া পড়েছে। সম্প্রতি চার মাসের বিল বাবদ ১৭ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা অর্থ বিভাগের কাছে ভর্তুকি চেয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত অর্থবছর পিডিবির লোকসান হয় ৩১ হাজার ৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। এক বছরে লোকসান বেড়েছে ১৯ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই ও আগস্ট) পিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। লোকসানের একটি বড় কারণ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিশোধিত উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ। বিনিয়োগ ও অন্যান্য ব্যয়ের বিপরীতে একটা নির্ধারিত হারে অর্থ উদ্যোক্তাদের ফেরত দেওয়ার শর্ত থাকে চুক্তিতে। বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে এই অর্থ দিতে হয়, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত। ২০০৮-০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে প্রায় ৯০ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে পিডিবি। আদানির বিদ্যুৎ আমদানির শুরুর পর এই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের হার আরও বাড়বে। ফলে পিডিবির লোকসানের পরিমাণও বাড়বে। পিডিবির তথ্যমতে, আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আনতে বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে প্রায় ৩ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা, যা বর্তমানে ভারতকে দেওয়া ক্যাপাসিটি চার্জের দ্বিগুণ। ২৫ বছরে আদানিকে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৯৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা দিতে হবে বাংলাদেশকে।
মন্তব্য করুন