কারখানা হলো পণ্য উৎপাদনের ঘর। এখানে নিরেট উৎপাদন চলে। বাইরে থেকে কাঁচামাল আসে, এখানে আকার পায়। কোনো কোনো কারখানায় উৎপাদিত হয় শক্তি। এখানকার মানুষজন কি যন্ত্র হয়ে যায়? মানুষের ভেতর একটা সহজাত প্রবণতা কাজ করে যন্ত্র না হওয়ার। মানুষ নিজেকে সজীব রাখতে চায়। এই তাড়না তার ভেতর প্রকৃতিগত। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের বিদ্যমান বাস্তবতায় তাকে যখন ছক মেপে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাকে ছুঁতেই হয়, তখন তার সেই প্রবণতা বাধা পায়। মানুষ জন্মগতভাবে সৃজনশীল এবং সৃষ্টির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে। যখন তাকে নিছক উৎপাদনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হয়, কারখানার কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হয়, তখনও সে এমন কোনো উপায় কাছে রাখতে ভালোবাসে, যে উপায় তাকে যন্ত্র হয়ে ওঠা থেকে বাঁচাবে।

বাংলাদেশে যেসব বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী বেসরকারি প্লান্ট রয়েছে, সেসবের মধ্যে সামনের সারিতে থাকবে সামিট পাওয়ার লিমিটেডের নাম। সম্প্রতি এখানে শিল্পের সঙ্গে শিল্পের মিলন হয়েছে। গাজীপুরের কড্ডায় সামিট পাওয়ার ৪৬৪ মেগাওয়াটের প্লান্টে ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের ৬২টি ভাস্কর্যশিল্প স্থান পেয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে কোনো কারখানার ভেতর এমন শিল্প উদ্যান সৃষ্টির প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। গোটা সামিট পাওয়ার প্লান্ট এখন একই সঙ্গে হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য উদ্যান। যেখানেই এক টুকরো জায়গা মিলেছে, সেখানে কোনো না কোনো ভাস্কর্যশিল্প স্থান পেয়েছে। স্থান ও বিষয় উপযোগী ভাস্কর্যগুলো যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনই শিল্পোত্তীর্ণ। সারাবিশ্বে ভাস্কর্যের ভুবন হলো প্রতীকের ভুবন।

প্রতীকের প্রতি মানুষের এমন নৈবেদ্য অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। তাই প্রতিটি জাতির শিল্পকর্মে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভাস্কর্যশিল্প। স্থান পাওয়া ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইনস্টলেশন, বার্ডস ফ্যামিলি, মর্নিং সান, উইমেন ইন রেস্ট, বার্ড, নোন ফর্ম সিরিজ, সোয়ান, রিদম, ব্যালান্স, রেড সোয়ান, কিংফিশার, শেল, ওয়েটিং, ডায়নামিক রিদম ইন ফর্ম, সিটিং বার্ড, স্পিরিচুয়ালিটি, রিমেম্বার সেভেন্টি ওয়ান, ফ্লাইং বার্ড, ওয়েটিং মাদার, নির্ভানা, গেস্ট অব নাইট, রিল্যাক্স, বার্ড ইন মুভমেন্ট, লাইফ অ্যান্ড লাইফলস, পিস বার্ড, ফ্লেমস, ব্ল্যাক মুন, ইমেজ অব সংশপ্তক, ফর্ম অব বিউটি, দ্য সান, হিরণ, মোশন, আর্কিটেকচারাল ফর্ম, সিড, লিভস, নেচার, ওয়াচার, মেকানিকাল ম্যান, ইমেজ অব ইউনিভার্স, ঈগল আই, ৭ মার্চ ১৯৭১, রিদমলেস অ্যান্ড স্টিল, ম্যুরাল, পন্ড, কম্পোজিশন সিরিজ, সাউন্ড অব নেচার, শ্রম ও সৃষ্টি প্রভৃতি।

কারখানায় প্রবেশের পরই সবাই দেখতে পাবে সেদিনের শিল্পিত সূর্য উঠেছে। এরপর দিনভর তরঙ্গিত দিনযাপনের সঙ্গে দেখতে পাবে কখনও ছন্দ কখনও বিশ্রামের প্রতীক ভাস্কর্যগুলো। যেখানে সবাই এক হবে, সেখানে দেখতে পাবে একাত্তরের স্মারক। কর্মক্লান্ত প্রকৌশলী-শ্রমিকরা দেখবে মায়ের প্রতীক, দেখতে পাবে অপেক্ষমাণ প্রিয়জনের প্রতীক- যাদের জন্য তারা মেহনত করছে, যাদের জন্য তাঁরা ঘরে ফিরে যাবে। যখন জলাশয়ের ধারে যাবে, চোখে পড়বে রাজহাঁস। মনকে প্রণোদনা দেবে মুক্ত পাখির নানা রকম আকার। মনকে ভাবাবে বিমূর্ত কিছু নকশা। যেখানে দর্শক আরোপ করতে পারবে তার অজস্র অসংজ্ঞায়িত অনুভূতিকে।
কারখানায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ম্যুরালচিত্র শ্রম ও স্মৃতি। এটির দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট, উচ্চতায় ২৩ ফুট। এই ম্যুরালচিত্রটিই গোটা কারখানাকে ভাস্কর্য উদ্যানে পরিণত করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করেছে। শিল্পী হামিদুজ্জামান খান বলেন, "একদিন আজিজ খান (সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান) আমাকে বললেন, 'সামিটের কড্ডা পাওয়ার প্লান্টে একটি ৪০০ ফুট দেয়াল আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সাহেবের ইচ্ছা, একজন শিল্পী এখানে কিছু করুক। আপনি গিয়ে দেখেন কী করা যায়।' দেয়ালটা দেখে আমার খুব ভালো লাগল। বিরাট দেয়াল। আমি বড় ক্যানভাসে কাজ করি। কিন্তু সেটা ৩০-৪০ ফুটের বেশি নয়। এখানে এত বড় ক্যানভাসে কাজ করব, আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগল।"

দেয়ালটিকে ম্যুরাল স্থাপনের জন্য পরে বিশেষভাবে বদলে দেওয়া হয়। ক্রমেই আরও ভাস্কর্য স্থাপনের পরিকল্পনা করা হলে ভাস্কর্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে মাঠ ও বাগানের নানা অংশে পরিবর্তন আনা হয়। বেশিরভাগ ভাস্কর্যকর্ম ধাতুনির্মিত। কিছু কিছু স্থলে ব্যবহূত হয়েছে পাথর। বড় বড় ভাস্কর্যের কোনো কোনোটির ওজন তিন থেকে চার টনের ওপর। উচ্চতায় কোনো কোনোটি বিশ ফুট উঁচু। ধাতুর সরবরাহ এসেছে কারখানার পরিত্যক্ত ধাতব যন্ত্রপাতি থেকে।

গত ২৪ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। পরে শিল্পীসহ গোটা বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘুরে দেখার পর তিনি মুগ্ধ প্রতিক্রিয়ায় শিল্পী ও উদ্যোক্তা উভয়ের প্রশংসা করেন। একদিকে বিদ্যুৎশিল্প, আরেকদিকে ভাস্কর্যশিল্প। একটি কাজ করে মানুষের বাইরের জগতে, আরেকটি কাজ করে অন্তর্জগতে। এ দু'য়ের সমন্বয়ে দর্শনীয় এক ভারসাম্য সৃষ্ট হয়েছে সামিট পাওয়ারের কড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। যন্ত্রযজ্ঞের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে নন্দনের প্রতীক।

বিষয় : ভাস্কর্যের গ্রাম ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্যশিল্প

মন্তব্য করুন