
যাপিত জীবনের সব ক্লান্তি সমুদ্রের জলে ভেজাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিন বন্ধু বেরিয়ে পড়লাম নীল জলের খোঁজে। চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেস থেকে এস আলম বাসের টিকিট কাটলাম। রাত ১২টায় গাড়িতে উঠলাম টেকনাফের উদ্দেশে। ভোর ৬টায় নামলাম টেকনাফে। টেকনাফ কক্সবাজারের একটি উপজেলা। এই উপজেলায় আগে যাওয়া হয়নি। বাস থেকে নেমেই কেয়ারি জাহাজের তিনটি টিকিট নিয়েছি। ৮৫০ টাকা করে নিয়েছে। আসা-যাওয়ার জন্য এক টিকিট। টিকিট কাটার পর দুই-আড়াই ঘণ্টা সময় ছিল। ফ্রেশ হওয়ার পর জাহাজে উঠলাম ১০টার দিকে।
সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সময় জাহাজ ভ্রমণের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেন। আমরা নাফ নদ থেকে জাহাজে উঠি। এ নদের সঙ্গে সমুদ্রের সংযোগ রয়েছে। এ নদ দিয়েই সেন্টমার্টিন দ্বীপে পৌঁছতে হবে। নাফ নদের পরই বঙ্গোপসাগর। আর সাগরের মাঝখানে সেন্টমার্টিন দ্বীপ।
জাহাজে ওঠার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে তা ছেড়ে দেয়। জাহাজের চারপাশে তখন গাঙচিল উড়ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে পুরো মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে গাঙচিল। হাজার হাজার পাখি জাহাজের চারপাশে উড়ছে। কী যে সুন্দর দৃশ্য! লিখে কিংবা বলে বোঝানো সম্ভব না।
জাহাজের অনেক যাত্রী আগে থেকে এই বিষয়ে অবগত থাকায় চিপস কিনে রেখেছিলেন পাখিদের খাওয়াবে বলে। আমরা অবশ্য সেটি করিনি। অন্যদের চিপস খাওয়ানো উপভোগ করেছি। গাঙচিলগুলো এতটাই কাছে এসে উড়ছিল, মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। কিন্তু কোনোভাবেই ছুঁতে পারছিলাম না। তবে এ দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করতে ভুলিনি।
যখনই জাহাজ নদ পাড়ি দিয়ে সমুদ্রে নামল তখন গাঙচিলগুলো আর পিছু এলো না। এটাই ওদের শেষ গন্তব্য। এ ছাড়া জাহাজ থেকে আপনি চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। মিয়ানমার সীমানা দেখতে পাবেন, জেলেদের মাছ ধরাও দেখতে পাবেন। সব মিলিয়ে আড়াই ঘণ্টার বেশি এই জাহাজ ভ্রমণ আপনাকে এক সেকেন্ডও বিরক্ত করবে না। অনেকের কাছে সেন্টমার্টিন যাওয়ার বড় উপভোগ্য বিষয় এটি।
আনুমানিক দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পৌঁছলাম সেন্টমার্টিন জেটিতে। প্রথমবার সেন্টমার্টিন যাওয়ার প্রবল আনন্দ আমাকে সাময়িক বাক্রুদ্ধ করেছে। জাহাজ থেকে সেন্টমার্টিনে পা রাখলাম আমরা তিনজন। চারদিকে তাকাচ্ছিলাম শুধু। হুমায়ূন আহমেদের সেই দারুচিনি দ্বীপ এটি। বইয়ের পাতায় পাতায় যা পড়েছিলাম, দু'চোখ দিয়ে সেসব খুঁজছিলাম।
বেশি সময়ক্ষেপণ না করে হোটেলে রুম খুঁজতে লাগলাম। পছন্দমতো একটি রুম পেয়েও গিয়েছি। তিনজন ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেতে গেলাম। খাবার খেলাম সামুদ্রিক মাছ আর বেগুন ভাজা দিয়ে। সেন্টমার্টিনে নানা জাতের মাছ পাওয়া যায়। প্রতিটি হোটেলের বাইরে টেবিলের ওপর মাছ সাজিয়ে রাখা হয়। যার যেটা পছন্দ হয়, তাকে সেটিই রান্না করে দেওয়া হয়। মাছভেদে দামও ভিন্ন।
খাবার খেয়ে গেলাম সমুদ্রের কাছাকাছি। নীল জলরাশিতে পা ভেজানো মাত্রই শরীরের ক্লান্তি পালিয়ে গেছে। এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব হচ্ছিল। খালি পায়ে হাঁটলাম আর ছবি তুললাম।
আমরা রাতে বারবিকিউ করার জন্য মাছ খুঁজছিলাম। সেন্টমার্টিনে একটু সস্তায় মাছ কিনতে মাছের আড়তে যেতে হয়। খোঁজ নিয়ে সেখানে গেলাম। একটি বড় কোরাল পছন্দ করলাম। দাম প্রায় আড়াই হাজার। মাছটি পরিচিত হোটেলে বারবিকিউ করার জন্য দিলাম। মাছ হোটেলে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
শরীরে শাল মুড়িয়ে সেন্টমার্টিনের রাস্তায় হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা হুমায়ূন আহমেদের রিসোর্ট দেখতে পেলাম। এরপর আমরা গেলাম সেন্টমার্টিনের বিচের মার্কেটে। যেখানে আচারসহ নানা জিনিস পাওয়া যায়। তিনজন কেনাকাটা করলাম। কেনাকাটা করে ফিরে আসছিলাম। দেখা মিলল প্লাস্টিক দিয়ে বানানো মাছের ম্যুরালের। এটি নান্দনিক এবং অসম্ভব সুন্দর কাজ। আমাদের পর্যটকদের জন্য একটি বার্তাও। প্লাস্টিক যেখানে সেখানে না ফেলে তা নির্দিষ্ট স্থানে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে এই ম্যুরাল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা হোটেলের কাছাকাছি গেলাম।
১০টার দিকে মাছের বারবিকিউ খেতে চলে গেলাম। বেশ সুস্বাদু এই কোরাল মাছের বারবিকিউ যেন মাংসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। খাওয়া শেষ করে আবারও বিচে গেলাম। বিচে গিয়ে ডাবল সিট নিয়ে তিন বন্ধু বিশ্রাম নিলাম আর সাগরের জলরাশির শব্দ শুনছিলাম। সাগরের প্রতিটি ঢেউ যেন একেকটা কাব্যের মতো। নিস্তব্ধ রাতে সাগরের ঢেউয়ের শব্দটা বেশ মধুরও বটে। রাত প্রায় ২টা বাজে। এবার রুমে ফেরার পালা। আমাদের হোটেলের উঠানে আবার দোলনা আছে। এক বন্ধু রুমে চলে গেলেও আমি আর আমার বন্ধু নাহিদ বাইরে দোলনায় কিছু সময় কাটালাম। এরপর রুমে ঘুমাতে গেলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাশতা করতে গেলাম। নাশতা সেরেই সমুদ্রে গোসল করতে গেলাম। পানিতে অনেক হইচই করে রুমে ফেরার পথে সেন্টমার্টিনের ডাব খেলাম। সেখানের ডাবের পানিও যে এত সুস্বাদু হবে কল্পনা করিনি। রুমে ফিরে গোসল সেরে সব গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেলের রুমের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে আমরা গেলাম খাবারের হোটেলে। পরিচিত ওই হোটেলের খাবারের মান আমাদের মুগ্ধ করেছে। সেন্টমার্টিনে এই দোকানটাও বেশ জনপ্রিয়। দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা চা পান করতে করতে কখন যে ঘড়ির কাঁটা আড়াইটা পেরিয়ে গেল বলতে পারব না। এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় জাহাজের ভেতর একদল তরুণ গান গাইছিলেন। কেউ কেউ কার্ড খেলছিলেন। আমরা বসে বসে সমুদ্রযাত্রা উপভোগ করেছি। ফিরে আসার সময় ভেবেছি সেন্টমার্টিন মূলত যাওয়া উচিত রহস্যের সন্ধানে- নির্জনতার রহস্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রহস্য আর সাগরতলের বিস্ময়কর রহস্য। সৃষ্টিকর্তা এখানকার প্রকৃতিকে দু'হাত ভরে দান করেছেন। পরিশেষে সমুদ্রের ঘ্রাণ নিয়ে আকাশের বিশালতা অনুভব করতে করতে টেকনাফ পৌঁছলাম।
গন্তব্য সেন্টমার্টিন
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে শ্যামলী, হানিফ, রিলেক্স, সেন্টমার্টিনসহ বিভিন্ন বাসে করে সরাসরি টেকনাফে যাওয়া যায়। নন-এসি বাসের ভাড়া ৯০০ টাকা আর বেশিরভাগ এসি বাসের ভাড়া ১ হাজার ৫৫০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফের ভাড়াও ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
এরপর দমদমিয়া ঘাট থেকে বেশ কয়েকটি জাহাজ ছাড়ে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে সকাল সাড়ে ৯টায়, যা দ্বীপে পৌঁছে ১২টার মধ্যে। এগুলো ফিরে আসে বেলা ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন থেকে। জাহাজ ও ক্লাসভেদে এগুলোর ভাড়া ৫৫০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত। তবে অফ সিজনে (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) জাহাজ চলে না। এই সময়টায় সেন্টমার্টিন যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ট্রলার।
কোথায় থাকবেন
সেন্টমার্টিনে রাতে থাকার জন্য নানা মানের রিসোর্ট, হোটেল ও কটেজ রয়েছে। ছুটির দিনে গেলে আগে থেকে বুকিং দিয়ে যাওয়া সুবিধাজনক। তবে চাইলে সেখানে গিয়েও পছন্দমতো রিসোর্ট ঠিক করতে পারবেন। সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে ১০-১৫ হাজার টাকার রুমও আছে প্রতি রাতের জন্য।
মন্তব্য করুন