করোনাকালে ধনী দেশগুলোতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের ব্যাপক প্রণোদনা, করোনা-পরবর্তী সরবরাহ সংকট, ন্যাটো-রাশিয়া যুদ্ধ, রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে উদ্ভূত বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্য সংকট- আন্তর্জাতিকভাবে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে দেখা দেয় ডলার সংকট। হুহু করে বেড়ে যায় ডলারের দাম; বাড়ে মুদ্রাস্ম্ফীতি। আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ ৯.৫২ শতাংশে উঠে ধীরে ধীরে নেমে ডিসেম্বরে তা হয় ৮.৭১ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ বাজারে আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে ধরে রাখতে সরকার বাড়িয়ে দেয় ভর্তুকি, কমিয়ে দেয় কর। ডলারের দাম ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলাসদ্রব্য এবং কম প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বাড়ায় বিদেশি ঋণপত্রের জামানতের পরিমাণ এবং রিজার্ভ থেকে কম দামে বাজারে ছাড়ে ডলার। সরকার চলতি বাজেটে কর বাড়িয়েছে বেশ কিছু বিলাসদ্রব্যের ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার নিয়ে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হয় বিপুল পরিমাণ টাকা। তৈরি হয় তারল্য সংকট।

এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে যে পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে- ব্যাংক জমার এবং ভোক্তা ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেওয়া বা রেপো ঋণের সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ শতাংশ ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া বা রিভার্স রেপো ঋণের সুদ ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪.২৫ শতাংশে উন্নীত করা। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব রকম ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ এবং জমার ওপর সুদের হার ৬ শতাংশ বেঁধে দিয়েছিল। সুদের হার নামিয়ে আনা এবং সরকারের লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনার ফলে করোনাকালে বাংলাদেশের অর্থনীতি গতিশীল থেকেছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে এ সময় মন্দা দেখা দিলেও বাংলাদেশে মন্দা দাঁত বসাতে পারেনি, উল্টো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে- ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩.৫১ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬.৯৪ শতাংশ এবং ২০২১-২২ সালে ৭.২৫ শতাংশ।

নতুন মুদ্রানীতির ফলে ভোক্তা ঋণের সুদের হার ১২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাড়তি জামানত পাবে, তারল্য সংকট কিছুটা কাটাতে পারবে, বেশি সুদে ভোক্তা ঋণ দিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ পাবে। আমাদের দেশে ভোক্তা ঋণের মাধ্যমে প্রধানত বাড়ি, গাড়ি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, কম্পিউটার ইত্যাদি জাতীয় বিলাসদ্রব্য কেনা হয়; যার বেশির ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করা। বিশ্বব্যাপী চলমান এই অর্থনৈতিক সংকটকালে ধার করে ঘি খাওয়া উচিত নয়। সামনের দিনে বিশ্ব পরিস্থিতি কোথায় যাবে, তাও কেউ জানে না। এমন সময়ে ভোক্তা ঋণের সুদের হার বাড়ানোর ফলে এসব জিনিসের চাহিদা কমে যাবে, আমদানি তথা ডলারের ওপর চাপ কমবে, ডলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে, অতিরিক্ত মুদ্রাস্ম্ফীতির ফলে জামানতকারীদের সুদ আয় শূন্যের নিচে নেমে গিয়েছিল। ব্যাংক জমার ওপর সুদের সীমা তুলে দেওয়ায় তাদের বাড়তি আয়ের পথ খুলেছে।

গত বছর মুদ্রাস্ম্ফীতি বাড়তে শুরু করলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সব ধরনের ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদের সীমা তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। ব্যাংকারদের পাশাপাশি কয়েকটি সংবাদমাধ্যম, কয়েকজন অতি পরিচিত অর্থনীতিবিদ বাণিজ্যিক ঋণের ওপর সুদের সীমা তুলে না দেওয়ায় মুদ্রানীতির সমালোচনা করে এটাকে দুর্বল, অকার্যকর, ধনিকবান্ধব, মুদ্রাস্ম্ফীতি বৃদ্ধিকারী মুদ্রানীতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের সমালোচনার প্রধান যুক্তি হচ্ছে- বিশ্বব্যাপী চলমান মুদ্রাস্ম্ফীতি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সবাই সুদের হার বাড়িয়েছে- অতএব, আমাদেরও সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ঋণের (যা মোট ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশ) সুদের সীমা না বাড়ানোয় মুদ্রাস্ম্ফীতি আরও বেড়ে যাবে বলে তাঁরা মতামত দিয়েছেন।

বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে যে মুদ্রাস্ম্ফীতি দেশে হয়েছে, তা স্থানীয় নয়, আমদানীকৃত। এই মুদ্রাস্ম্ফীতির কারণ বাজারে অতিরিক্ত তারল্য নয় যে সুদের হার বাড়িয়ে সে তারল্য নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা যাবে। উল্টো আমাদের এখানে তারল্য সংকট চলছে। সুদের হার বাড়ালে বাজার থেকে আরও বেশি নগদ অর্থ জামানত আকারে ব্যাংকে চলে আসবে, বাড়তি সুদের কারণে সে টাকার অনেকাংশ আবার বাজারে ফিরতে পারবে না, অর্থাৎ বিনিয়োগ কমে যাবে। কৃষি, শিল্প, সেবা- সব রকমের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে; রপ্তানিসহ সব রকমের পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে; জাতীয় আয় কমে যাবে। বাড়তি মুনাফা গুনবে গুটিকয় ব্যাংক মালিক আর বেতন মোটা হবে কয়েকজন ব্যাংকারের।

পশ্চিমা মুদ্রাস্ম্ফীতির প্রধান কারণ দুটি- নগদ অর্থ ছাপিয়ে বাজার সয়লাব করা এবং ইউক্রেনে ন্যাটো-রাশিয়া যুদ্ধ। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধনী দেশগুলো ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট এবং করোনার প্রভাব মোকাবিলা করতে গিয়ে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার নগদ অর্থ ছেপে তা বাজারে ছেড়েছে। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলার নগদ বাজারে ছেড়েছে; যুক্তরাজ্য ছেড়েছে ৮৯৫ বিলিয়ন পাউন্ড। এই বাড়তি নগদ প্রবাহ তাদের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ম্ফীতি সৃষ্টি করে; যা ইউক্রেনে ন্যাটো-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ৬-৭ শতাংশে উঠে যায়। যুদ্ধ শুরু হলে তা ১০ শতাংশ অতিক্রম করে। তাদের মুদ্রাস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির যৌক্তিকতা রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত অনেক অর্থনীতিবিদ সুদের হার বৃদ্ধির সমালোচনা করে বলেছেন, সুদের হার পণ্য সরবরাহ বাড়ায় না।

আমাদের দেশের মুদ্রাস্ম্ফীতির একমাত্র কারণ আন্তর্জাতিক সংকট, অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ নয়। এখানে মুদ্রাস্ম্ফীতি হয়েছে মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যে। তদুপরি, অন্য সব খরচ বাদ দিয়ে হলেও সাধারণ মানুষ এসব পণ্য কিনতে বাধ্য হয়। সুদহারের সঙ্গে এসব পণ্যের চাহিদার সম্পর্ক নেই। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এখানকার সাধারণ মানুষ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল কেনে না। ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা পণ্য সরবরাহ করেন। সুদের হার বাড়ানো হলে পণ্য সরবরাহ খরচ বেড়ে যায় বলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, বিনিয়োগ কমে, কর্মসংস্থান কমে, মানুষের আয় কমে।

সাব্বির আহমেদ: কলাম লেখক ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট