ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) সার্থক করতে এ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সংকট নিরসন না করে এ অঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। তাই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ আইপিএসের সুবিধা নিতে পারে। গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেছেন বিশিষ্টজন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের আয়োজনে 'বাংলাদেশ এবং ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সহযোগিতা :অগ্রাধিকার ইস্যু এবং উদ্বেগ' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। এ ছাড়া কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত আলোচনায় অংশ নেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম। সঞ্চালনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান।

রোহিঙ্গাদের ওপর বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন নিয়ে সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, জঙ্গিবাদ, মানব পাচার, মাদক কারবার, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মতো অপরাধমূলক কার্যক্রমে রোহিঙ্গারা জড়িত থাকলে বাংলাদেশ জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো আপস করবে না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ পুলিশের সমালোচনা করেছে। ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। তিনি আশা করেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তাকারী দেশগুলো তাদের কার্যক্রমের সুরক্ষা দেবে। এরই মধ্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ একাধিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। রোহিঙ্গাদের অর্থায়নে দাতাদের অংশগ্রহণ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিশ্ব থেকে রোহিঙ্গাদের চাহিদার অর্ধেক অর্থ জোগাড় করতেও বেগ পেতে হয়। এদিকে প্রতিকূলতার মধ্যেও ২০২১ সালে বাংলাদেশ ১২০ কোটির বেশি টাকা রোহিঙ্গাদের পেছনে খরচ করেছে। ২০২২ সালে দাতা দেশগুলোর অর্থায়নেরও সমালোচনা করেন তিনি।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান বলেন, বিভিন্ন দেশ ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ফোরামে (আইপিইএফ) যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এর সদস্য হতে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আইপিইএফের যে ভিত্তিগুলো রয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটির ক্ষেত্রে ভারত আপত্তি জানিয়েছে। এর মানে হচ্ছে, ভিত্তিগুলোর মধ্যে পছন্দ অনুযায়ী বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ এতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা-অসুবিধাগুলো বিবেচনা করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সংকট অনেক বড়। আমরা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনকে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে দেখতে চাই। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, শান্তিপূর্ণভাবে এ সংকট সমাধান করার বিষয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সুবিধা নিয়ে সংকট নিরসন করার বিষয়টি বাংলাদেশ বিবেচনা করতে পারে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট তীব্র হওয়ার পর বাংলাদেশ তা নিরসনে কূটনৈতিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ প্রচেষ্টা থেকে আমরা কিছু অর্জন করতে পারিনি। একজন রোহিঙ্গাও ফেরত যায়নি। সংকট নিরসনে তিনি আরাকান আর্মির সঙ্গে দরকষাকষির পরামর্শ দেন।

ভারত ও চীন দুই দেশেরই জ্বালানি চাহিদা রয়েছে মন্তব্য করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমান বলেন, চীন মিয়ানমারকে তার জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করে থাকে। একইভাবে মিয়ানমারে ভারতের কালাদান প্রকল্প একটি কৌশলগত প্রকল্প। ভূকৌশলগত কারণে ভারত কখনোই চায় না মিয়ানমার পুরোপুরি চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাক। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থান ধরে রাখতে মিয়ানমার ও পাকিস্তানে বিনিয়োগ করছে চীন। ফলে এখানে ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত 'টেকটোনিক প্লেট'-এর নড়াচড়া হচ্ছে।

জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনরি বলেন, ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে অবাধ ও মুক্ত দেখতে চায় তাঁর দেশ। রোহিঙ্গা বিষয়ে জাপান তার অবস্থান পরিবর্তন করেনি। এ সংকটের সমাধান ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য জরুরি। তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হতে হবে নিরাপদে, সম্মানের সঙ্গে এবং স্বেচ্ছায়।