জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু- স্লোগানমুখর নগরী। একের পর এক মিছিল। সব মিছিল গিয়ে মেশে একই মোহনায়, অভিন্ন গন্তব্যে। ঠিকানা রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠ। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন জনসভা মঞ্চে ওঠেন, তখন সামনে শুধু মানুষেরই ঢেউ। পাঁচ বছর পর রাজশাহীতে এসে শেখ হাসিনা সবার কাছে আগামী জাতীয় নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট চাইলেন। উপস্থিত নেতাকর্মী প্রিয় নেত্রীর সামনে হাত তুলে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন।

রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত গতকাল রোববারের জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ জনগণকে দিতে আসে। ভোটে জিতলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহার পূরণ করে, মানুষ কিছু পায়। আমরা চাই, দেশ এগিয়ে যাক। দেশকে আমরা উন্নত করতে চাই।' তিনি বলেন, 'জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া- কেউ এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা দেয় নাই। চিন্তাও করে নাই। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে; বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করে।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'করোনাকালে আমি আসতে পারিনি। আজকে আপনাদের মাঝে এসে অনেক আনন্দিত। গত নির্বাচনে আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন। এ জন্য কৃতজ্ঞ। আগামী নির্বাচনেও আপনারা নৌকায় ভোট দেবেন কিনা ওয়াদা চাই। উন্নয়নের এই জয়যাত্রা ধরে রেখে যেন ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে পারি- সে জন্য নৌকায় আপনারা ভোট দেবেন।' এ সময় উপস্থিত নেতাকর্মী ও জনতা হাত উঁচিয়ে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠের জনসভায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ২৫টি উন্নয়নকাজের উদ্বোধন ও ছয়টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি বলেন, 'গত ১৪ বছরে রাজশাহী জেলা ও মহানগরে ১০ হাজার ৬৬০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করে দিয়েছি। শুধু এই রাজশাহী মহানগরে ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। ১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকার ২৬টি প্রকল্প আজ উদ্বোধন করলাম। ৩৭৫ কোটি টাকার ছয়টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম। প্রকল্পগুলো আমি আপনাদের জন্য উপহার হিসেবে দিয়ে গেলাম।'

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ৩টা ৫৩ মিনিটে জনসভায় বক্তব্য শুরু করেন। প্রায় ৩০ মিনিটের বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, 'দেশে লেখাপড়া করার জন্য আমরা প্রায় প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছি। মেডিকেল কলেজ বড় বড় জেলায় করে দিচ্ছি। একসময় শুধু ডিপ্লোমা নার্স ছিল। আমরা গ্র্যাজুয়েশন নার্স করে দিচ্ছি এবং নার্সদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমরা মানুষের জন্য কাজ করি। বিএনপি কী করে? বিএনপির কাজ হলো মানুষ খুন করা; অগ্নি-সন্ত্রাস তাদের কাজ। বিএনপি ৩ হাজার ৮০০ বাস, ২৯টি ট্রেন, লঞ্চ, প্রায় ৭০টি সরকারি অফিস, ছয়টি ভূমি অফিস আন্দোলনের নামে পুড়িয়েছে।'

বিএনপি-জামায়াত জোটকে অমানবিক উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমি জানি না, আপনারা বিবেচনা করেন, কোনো মানুষ জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে! এই বিএনপি-জামায়াত কীভাবে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে? তারা মানুষ চেনে না। মানুষের জন্য কিছু করতে পারে না। তারা পারে কীভাবে দেশটাকে লুটেপুটে খাবে।'

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আয়েশি জীবন ও অর্থ পাচারের প্রসঙ্গ টেনে সরকারপ্রধান বলেন, 'যখন জিয়াউর রহমান মারা গেল, তখন দেখা গেল কী? জিয়া কিছুই রেখে যায় নাই, একটা ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি ছাড়া। এখন দেখেন, কীভাবে আয়েশি জীবনযাপন করছে। তারা মানি লন্ডারিং করে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে। আমরা ৪০ কোটি টাকা ফেরত এনেছি। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। সেই ডিজিটাল মাধ্যমে আমাদের গিবত গায়। আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় আর মানুষকে উস্কানি দেয়। এটাই তাদের কাজ।'


বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় পুলিশের পাহারায় বাংলাভাইয়ের মতো সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'বিএনপি বাংলাভাইয়ের মতো সন্ত্রাসী তৈরি করেছিল। এই রাজশাহীতে অস্ত্র হাতে নিয়ে তারা মিছিল করেছিল আর পুলিশ গিয়ে তাদের পাহারা দিয়েছিল। নৌকায় ভোট দেওয়ায় বিএনপি মানুষ হত্যা করেছিল। মহিমা, ফাহিমা, রজুফাদের ধর্ষণ করেছিল। নৌকায় ভোট দেওয়ায় এত রাগ কেন? এই নৌকায় ভোট দেওয়ায় দেশ স্বাধীন হয়েছিল। দেশ স্বাধীন না হলে জিয়া মেজর থেকে মেজর জেনারেল হতে পারত না। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হতে পারত না।'

তিনি বলেন, 'বিএনপির দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, লুটপাটের ফলে দেশে ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার (জরুরি অবস্থা জারি) হয়। ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ারের দরকার ছিল না। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে এমন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে মানুষ শান্তিতে থাকে। দেশের উন্নতি হয়। আমরা মানুষকে যে ওয়াদা দিই, সেই ওয়াদা রক্ষা করি।'

রাজশাহীর আমের প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'রাজশাহী আমে ভরপুর। রাজশাহীর অনেক ঐতিহ্য ছিল। বিএনপি তা ধ্বংস করেছে। আমরা তা আবার ফিরিয়ে এনেছি। সেই ঐতিহ্যগুলো যেন আবার ফিরে আসে। আম নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। বারোমাসি আম রপ্তানি হচ্ছে।'

কর্মসংস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো ছেলে বেকার থাকবে না- সেটাই আমাদের লক্ষ্য। রাজশাহীর মানুষের জন্য এরই মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে পদ্মা সেতু করেছি। এর আগে যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করে দিয়েছিলাম। পুরো বাংলাদেশ একটি যোগাযোগ নেটওয়ার্কে চলে এসেছে। কতগুলো এয়ারপোর্ট বন্ধ ছিল। আমরা সেগুলো চালু করে দিয়েছি।'

আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে পালানোর সময় পাবে না- বিএনপি নেতাদের এসব হুঙ্কারের জবাব দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, 'বিরোধী জোট অনেক কথাই বলে। তারা বলে, আমরা নাকি পালানোর পথ পাব না। বিএনপি-জামায়াত জোট যারা হয়েছে তাদের জিজ্ঞেস করি, পালায় কে? আওয়ামী লীগ কখনও পালায় না, পিছু হটে না। জিয়াউর রহমান আমাকে বাধা দিয়েছিল, দেশে আসতে দেবে না। আমি তখন বাধা অতিক্রম করে দেশে ফিরে এসেছিলাম। যারা বলে, আওয়ামী লীগ পালানোর সময় পাবে না; তাদের উদ্দেশে বলি- আওয়ামী লীগ পালায় না; পালায় আপনাদের নেতারাই। বিএনপি নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। কাকে নিয়ে? দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত বর্তমান তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে। যে নাকি ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাদের কাছে স্ট্যাম্প কাগজে মুচলেকা দিয়েছিল আর কোনো দিন রাজনীতি করবে না বলে ভেগে গিয়েছিল, পালিয়ে গিয়েছিল।'

রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামালের জনসভায় সভাপতিত্ব এবং সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার পরিচালনা করেন।

জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পদ্মা নদীর সব ঢেউ আজ রাজশাহীতে চলে এসেছে। জনসভায় লাখ লাখ মানুষ এসেছে। আজকের এই জনসভা আর জনসভা নেই, জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। বিএনপি লাল কার্ড দেখায়। বলে যে, ১০ ডিসেম্বর সরকারের পতন হবে, ৩১ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা থাকবে না, ১১ ডিসেম্বর সরকার আর থাকবে না। সরকার কি আছে? সরকার তো রয়ে গেছে। বিএনপির এখন কী অবস্থা? পদযাত্রা! পদযাত্রা মানে মরণযাত্রা, শেষ যাত্রা। বিএনপি আর নেই। বিএনপির এখন শেষ যাত্রা চলছে। মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারকে পালাতে হবে। আমরা বলি, ফখরুল সাহেব! পালিয়ে আছেন তো আপনারা। আপনার নেতা তারেক রহমান লন্ডনে পালিয়েছে। আমরা পালাব না। এই দেশে জন্মেছি আমরা, এই দেশেই মরব। প্রয়োজন হলে ফখরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠব।

বিএনপিকে উদ্দেশ করে সেতুমন্ত্রী বলেন, জ্বালা, অন্তর্জ্বালা! পদ্মা সেতুর জ্বালা, মেট্রোরেলের জ্বালা, এরপর বঙ্গবন্ধু টানেলের জ্বালা আসতেছে। এক জ্বালা শেষ না হতেই আরেকটা উন্নয়নের জ্বালা। সামনে আরও জ্বালা আছে। পাতাল রেল, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালা। খেলা শুরুর আগেই তো তাদের পালানো শুরু হয়ে গেছে। এখন তো খেলা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, আগুন-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। আগামী নির্বাচন হবে ফাইনাল খেলা। বিএনপির এখনও শিক্ষা হয়নি। আগামী নির্বাচনে পরাজয়ের মুখ দর্শনের মাধ্যমে আবার শিক্ষা হবে।

প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সহযোগিতা না করতেন, তাহলে কোনো দিনই রাজশাহীতে এত উন্নয়ন করতে পারতাম না। এই উন্নয়নের আসল কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জনসভায় আরও বক্তব্য দেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল ও আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার সংসদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।

দীর্ঘদিন পর সরকারপ্রধান রাজশাহী আসায় এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ছিল বাড়তি উৎসাহ। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী জনসভা মঞ্চে পৌঁছানোর আগেই মাঠ ভরে যায় কানায় কানায়। পরে মাঠ ছাপিয়ে আশপাশের রাস্তায় অবস্থান নেন নেতাকর্মী-সমর্থক। নগরের বিভিন্ন স্থানে বড় পর্দায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচার করা হয়। এটিকে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জনসভা বলে দাবি করছেন নেতাকর্মীরা।