কোনো কোনো জাতির জীবনে একেকটি তারিখ ইতিহাসিত বাস্তবতা হয়ে যায়। ক্রমে হয়ে যায় রিচুয়াল শিল্পকৃত্য। বাঙালি জাতির ইতিহাসেও 'একুশ' শব্দটি তেমনি এক ইতিহাসিত রিচুয়াল। ভাষাকে কেন্দ্র করে জীবনজগৎ, সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলের যাবতীয় মানচিত্রের বদল ও নতুনরূপে বিনির্মাণের একটি সংগ্রাম হচ্ছে 'একুশ'। কবির ভাষায়- 'জাগ্রত বসন্ত দ্বারে' সমাগত প্রায়। এই একুশ বসন্তের ধারক তারুণ্যেরও প্রতীক। একুশ বছর বয়সই তারুণ্যের কাল। ভাষা ও তারুণ্য মিলেমিশে একুশ বাংলাদেশ ও ভাষাশক্তিরও প্রতীকতা। ভাষা মানেই বাস্তবতা। আমরা বাস্তবতাকে বুঝি ভাষার দ্বারাই। অন্যান্য জীবনজগৎ থেকে ভাষাই মানব প্রজাতিকে পৃথক করেছে। তাকে জগৎ নির্মাণের শক্তি দিয়েছে। দিয়েছে মনন, বিজ্ঞান, ধর্ম, শিল্প ও জ্ঞান। সেই ভাষাকে অবলম্বন করেই মানুষ বৈচিত্র্যময় রূপচারী হয়েছে। জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাঘন স্রষ্টা হয়েছে।

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতিদানের দাবিটা ছিল বাঙালির ক্ষমতায়নের উপায়। তৎকালীন নব্য-উপনিবেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাকে ভাষার সংগ্রাম দিয়েই ক্ষমতায়নের পথে অগ্রসর হতে হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষার দাবিটা আপাত অর্থে নিরীহ মনে হলেও এর গভীর তাৎপর্য ছিল শক্তিশালী সুদূরপ্রসারী স্বাধীনতা অর্জনের পাদপীঠ। কেননা, তাতে জড়িত ছিল শ্রেণিসংগ্রামের গোপন লড়াইও। ভাষার স্বীকৃতির অর্থই হচ্ছে রাষ্ট্রকে সাধারণ মানুষের অংশভাক নিশ্চিত করা, যা তৎকালীন পাকিস্তান সরকার দিতে চায়নি। কারণ এই রাষ্ট্র তখন ছিল জনবৈরী; ক্ষমতাধারীদের কবলিত। উচ্চ শ্রেণি তথা পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিত্ত ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গের ভোগদখলের ক্ষেত্র। বাঙালি তার মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি চাইছিল ওই ভোগদখলের বিরোধিতা করার জন্যই। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার জন্য। এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সামনের সারিতে যদিও ছিল তরুণ শিক্ষিত শ্রেণি, তবুও সেটি যে সব শ্রেণিরই দাবি ছিল, মুক্তির সূত্র ছিল- আজ তা স্পষ্ট। তাই বিরুদ্ধতাই শুধু নয়; সংঘবদ্ধতা একুশের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ বিরোধ-প্রতিরোধের চেয়েও শক্তিশালী ও দরকারি হচ্ছে সংঘবদ্ধ লড়াই। এই লড়াইটা আমরা করেছি মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই। একাত্তরও এই লড়াইয়ের হাত ধরে মুক্তি ও স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়ে সফল হয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রভাষা আজ সমার্থক এবং বাস্তব। কিন্তু অর্জন কতটুকু? শিক্ষা, জ্ঞানবিদ্যা ও শিল্প-সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার অবস্থান কোথায়? বিশ্বায়নের ডামাডোলে আমরা ইংরেজি ভাষার প্রবল চর্চা করছি। সংস্কৃতিক্ষেত্রে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন অপসংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা আজও অবহেলিত। কারণ স্বরূপ বলা হয়, উচ্চস্তরে জ্ঞানের বইগুলো ইংরেজিতে রচিত। কিন্তু পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশই উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষাকে ব্যবহার করছে। তবে আমরা কেন পারব না? এ লক্ষ্যে যেটা জরুরি তা হলো উচ্চশিক্ষার বইগুলো অনুবাদ করা; নিজেরা বই লেখা। একটি সুষ্ঠু শিক্ষাদর্শ আজও আমরা তৈরি করে উঠতে পারিনি। একমুখী শিক্ষার ধারা প্রবর্তন করা যায়নি। দেশের জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি আর তারুণ্যশক্তির যথাযথ ব্যবহার জ্ঞানার্জনের পথে অগ্রসর হয়নি। প্রযুক্তিবিদ্যা কিংবা ব্যবহারিক শিক্ষার প্রসার আরও বাড়ানোর প্রয়াস যতটা বেশি, তার চেয়েও বেশি দরকার একটি উচ্চশিক্ষিত জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, যুক্তিবাদী শ্রেণি তৈরি করা। আর তা করতে হবে মাতৃভাষাতেই। একটি ব্যাপার লক্ষ্যযোগ্য, এই বাংলায় বাংলা ভাষার একটি স্বকীয় রূপ দাঁড়িয়ে গেছে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষা ও মান ভাষার সংকরায়ন ঘটছে। বিশেষত, আঞ্চলিক ভাষাবৈচিত্র্য আমাদের বাংলা ভাষার মূল প্রাণশক্তি। এই শক্তিকে ব্যবহার করে সৃজন ক্ষমতাকে সমৃদ্ধ করা যেতে পারে। অর্থাৎ নিজেকে প্রকাশের জন্য ভাষার যে রূপ বাঞ্ছনীয়, তা অবশ্যই স্বতঃস্ম্ফূর্ত হতে হবে। তার ব্যাকরণ ও সুষ্ঠু বিন্যাস পদ্ধতি থাকতে হবে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে মান ভাষা প্রয়োজন; আর সৃজনশীল ক্ষেত্রে মিশ্র ভাষা প্রতিভাসম্মতভাবেই ব্যবহার করা যেতে পারে। তাই রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম বাংলায় সম্পন্ন করা যেমন আবশ্যক; তেমনি একাডেমিক ক্ষেত্রে একটি সুবিন্যস্ত নির্ভুল মান ভাষা গড়ে তোলা আবশ্যক। শুধু প্রযুক্তি বা অর্থনীতির বিকাশ ও প্রসার জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। জাতির সত্তা ও চেতনা বিকাশের ব্যাপারকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এ কারণেই তো একুশের জন্ম হয়েছিল। ইতিহাসও এ কথা বলে যে, ভাষার শক্তিই মনন ও সৃজনের জগৎকে যূথবদ্ধভাবে গড়েপিটে তোলে। 'একুশ মানেই মাথা নত না করা'- এ কথার চেয়েও মূল্যবান হলো, একুশ মানেই সভ্যতা ও মানবসত্তার নব নব নির্মাণ ও সম্প্রসারণ।

একুশের মর্ম তাই মানব-অস্তিত্বের সারাৎসার গঠনের পুঞ্জীভূত শক্তি। বাঙালির জন্য তা একই সঙ্গে আবেগ সত্তারও উৎসধারা; প্রবহমানতায় যা কালাতিক্রমী।

বিষয় : একুশের ৭১ বছর

মন্তব্য করুন