বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেনি, বরং বেড়েছে। এবারের বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের চেয়ে আরও এক ধাপ অবনমন হয়েছে। বিশ্বের ১৮০ দেশের মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১২। গতবার এ অবস্থান ছিল ১৩। স্কোরও ২৬ থেকে ১ পয়েন্ট কমে হয়েছে ২৫। এতে দেশে দুর্নীতির বিস্তৃতি এখনও উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশিষ্টজন।

বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) গতকাল মঙ্গলবার একযোগে বিশ্বের ১৮০ দেশের গত বছরের দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই-২০২২) প্রকাশ করে। একই দিন টিআইর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করে বাংলাদেশ অংশের দুর্নীতির ধারণা সূচক। রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারের টিআইবি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে নানা তথ্য উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
এতে বলা হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে এক ধাপ অবনমন হয়েছে। তবে ১৮০ দেশের তালিকায় ওপরের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো বদল হয়নি। অর্থাৎ আগের বছরের মতো ঊর্ধ্বক্রম দিক থেকে এবারও বাংলাদেশ রয়েছে ১৪৭তম স্থানে। আর নিম্নক্রম দিক থেকে ১৩ থেকে ১২তম অবস্থানে রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ১৮০ দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক। সূচকে ১০০-এর মধ্যে দেশটির স্কোর ৯০। এরপর যৌথভাবে ৮৭ স্কোর ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের। নরওয়ের স্কোর ৮৪। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে সোমালিয়া ১২, সাউথ সুদান ও সিরিয়া যৌথভাবে ১৩ এবং ভেনেজুয়েলার স্কোর ১৪।

এবারের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪৩-এর তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর এবারও অনেক কম। গত এক দশকের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর ও অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ এ অঞ্চলে স্কোর ও অবস্থান বিবেচনায় সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা আফগানিস্তানের ২০২১ সালের স্কোর ছিল ২৪। এবার তাদের ৮ পয়েন্ট বেড়েছে। একই সঙ্গে উচ্চক্রম অনুযায়ী দেশটি আগের বছরের চেয়ে ২৪ ধাপ এগিয়েছে।
দেশে গত এক দশকে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির প্রতি 'শূন্য সহনশীলতা' ঘোষণার পরও কার্যকর কৌশল ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারায় সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থানের অবনমন হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান বিবেচনায় না নিয়ে নির্বিশেষে দুর্নীতির দায়ে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে কার্যকর জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ ছয় দফা সুপারিশও তুলে ধরেছে টিআইবি।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সূচক অনুযায়ী শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে টানা চার বছর ২৬ স্কোর অপরিবর্তিত থাকার পর এবার ১ পয়েন্ট কমে ১২তম হিসেবে ২৫ স্কোর করেছে বাংলাদেশ, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। ২০১২ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১ দেশের মধ্যে চতুর্থ সর্বনিম্ন- এটাও অত্যন্ত বিব্রতকর। তিনি বলেন, বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক এই কারণে যে, ২০১২-২২ সালের দৃশ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন অবস্থানে অবনমনের শঙ্কার সম্মুখীন।

টিআই সূচক নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, সার্বিকভাবে বৈশ্বিক বিবেচনায় দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ১৮০ দেশের মধ্যে বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর কম স্কোর করেছে ১০৯টি। সূচকের আওতায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি, অর্থাৎ ১২২ দেশের স্কোর ৫০-এর নিচে- ওই সব দেশে দুর্নীতির মাত্রা উদ্বেগজনক। ২০২১ সালের চেয়ে ৭৩ দেশের স্কোর কমেছে। এর মধ্যে ২৬ দেশ ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্কোর করেছে। যাদের স্কোর কমেছে, তাদের মধ্যে অনেক দেশ সূচকে তুলনামূলকভাবে উচ্চতর অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে এমন অনেক দেশ রয়েছে, যাদের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এক ধরনের অসাধু চক্র বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচারের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ ও বিনিয়োগের সুযোগ করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রকারান্তরে বৈশ্বিকভাবে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এবারের ধারণা সূচক অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে কম ভুটানে। দেশটি সূচকে ৬৮ স্কোর পেয়ে সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী ২৫তম অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলের আটটি দেশের মধ্যে ছয়টি ২০২১ সালের চেয়ে এবার বেশি স্কোর অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে ভুটান, মালদ্বীপ ও ভারতের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার স্কোর ১ পয়েন্ট কমেছে এবং নেপালের ১ পয়েন্ট ও আফগানিস্তানের স্কোর ৮ পয়েন্ট বেড়েছে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স (শূন্য সহনশীলতা) নীতির সবচেয়ে আলোচিত সময়। এই সময়ে এ ঘোষণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি, বরং এ সময়ে দুর্নীতির ব্যাপকতা আরও ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। অর্থ পাচারের আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এলেও প্রতিরোধ ও প্রতিকারে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ঋণখেলাপি, জালিয়াতি ও অর্থ পাচারে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের ঝুঁঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি; বরং এর জন্য যারা দায়ী, তাদের পক্ষে বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অনৈতিক পথে ব্যাপকভাবে সম্পদ অর্জনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) বিভিন্ন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব প্রকট হয়েছে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণমাধ্যমসহ যারা দুর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী তথ্য প্রকাশ, দুর্নীতিবিরোধী চাহিদা সৃষ্টি ও তা প্রতিরোধে যারা যুক্ত, তাদের জন্য প্রতিকূল ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে কঠোর ভূমিকা নিতে দুদক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরও নাজেহাল হতে হয়েছে। এমনকি দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে- এমন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এ কারণে দুর্নীতি-সহায়ক ও বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্‌জুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্থার উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।