নির্মাণ শ্রমিক স্বামী রেজাউল করিম সকালে কাজে গেছেন। সন্ধ্যায় চালডাল নিয়ে এলে রাতের রান্না হবে। কিন্তু স্বামী আর ফেরেনি। চালডালও আসেনি। তাই সন্তানদের খাওয়াও হয়নি। মধ্যরাতে জানতে পারেন স্বামী রেজাউল করিমসহ দুই শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রাজশাহীর বিসিক শিল্পনগরীতে এমনই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন শ্রমিক রেজাউল করিম ও রাকিব।

নওগাঁর মান্দা উপজেলার সামাদের ছেলে রেজাউল করিম এবং শিবগঞ্জ উপজেলার গোলাম মোস্ত্মফার ছেলে রাকিব। তারা পরিবার নিয়ে রাজশাহীর ডাবতলা এলাকায় বাসবাস করতেন।বৃহস্পতিবার সকালে তারা বিসিকের মডার্ন ফুড কারখানায় নির্মাণ কাজে যান। বিসিক শিল্প নগরীর কারখানার জায়গাতেই বাড়ি করে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন আব্দুল মালেক ও তার পরিবার। বৃহস্পতিবার দুপুরে টাকা চুরির অপবাদ এনে আটক করা হয় শ্রমিক রেজাউল করিম ও রাকিবকে। তাদের আব্দুল মালেকের বাসার দুই তলায় নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। 

পুলিশ জানায়, আব্দুল মালেকের ছেলে আব্দুল্লাহ (৩৮), তার শশুর সপুরা এলাকার মাসুম রেজা (৫০), চাচাতো শ্যালক বায়া এলাকার শফিকুল ইসলামের ছেলে মঈন উদ্দীন রিয়াল (১৯) ও কর্মচারী পবার মিয়াপুরের মোশারফের ছেলে ইমরান নির্যাতন করতে থাকে। তাদের হাত পা বেঁধে মারপিট করা হয়। হাত ও পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়। দুপুর থেকে রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত তাদের ওপর নির্যাতন চলে। পরে পুলিশ বিষয়টি জানতে পেরে সেখানে অভিযান চালায়। এ সময় মুমূর্ষু অবস্থায় রেজাউল করিম ও রাকিবকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসক একজনকে মৃত ঘোষণা করেন। কিছুক্ষণ পর আরেকজনকেও মৃত ঘোষণা করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকেই আব্দুল্লাহ, মাসুম রেজা, মঈন উদ্দীন রিয়াল ও ইমরানকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে।

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার আরেফিন জুয়েল জানান, দুই শ্রমিকের নামে চুরির অপবাদ এনে অমানবিকভাবে নির্যাতন চালানো হয়। দুজনকেই অচেতন মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। তাদের নামে চুরির অপবাদ দিলেও এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

বোয়ালিয়া থানায় কান্নায় ভেঙে পড়েন রেজাউল করিমের স্ত্রী নার্গিস (ছবি-সৌরভ হাবিব) 

নিহতদের প্রতিবেশী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী আহসান হাবিব বলেন, দুজনের লাশ আমি উঠিয়ে এনেছি। তাদের সারা শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। হাত পায়ের নখ তুলে নিয়েছে। সারা শরীরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে।

রাত ১টায় স্বামী হত্যার বিচার পেতে বোয়ালিয়া থানায় ছুটে যান রেজাউলের স্ত্রী নার্গিস ও রাকিবের স্ত্রী সোমা। নার্গিস বলেন, ‘আমার স্বামী সকাল ৭টায় বের হয়ে যান কাজে। সন্ধ্যা সাতটাতেও আসে না। আমি চাল ডালের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার ছেলে-মেয়েরা ভাতের জন্য ঘুরছে। আমি বলছি, তোমাদের বাবা আসলে ভাত খাওয়াবো। আরেকটু অপেক্ষা করো। আমার ঘরে চাল ডাল কিছুই নাই। আমার একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। সে ভাতের জন্য কান্নাকাটি করছে। আমি চালডালের অভাবে রান্না করতে পারছি না। আমার ছেলে-মেয়ে না খেয়ে আছে। ফোন দিচ্ছি। ফোন রিসিভ হচ্ছে না। মধ্যরাতে জানতে পারছি আমার স্বামীকে খুন করা হয়েছে। আমার ছেলেমেয়েদের এখন কি খেতে দেব? তাদের কে মানুষ করবে? কাজ শেষে স্বামীর চালডাল নিয়ে ফেরার কথা। আমি এই খুনীদের বিচার চাই।’

নিহত রাকিবের স্ত্রী সোমা বলেন, ‘একবার ফোন করে রাকিব বলেছিলেন, তাদের বন্দি করে মারপিট করা হচ্ছে। বাড়ি যেতে দেয় না। পরে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছে। কোনো মানুষ এভাবে নির্যাতন করে মেরে ফেলতে পারে? আমি এই হত্যার বিচার চাই। আমার ছোট ছোট দুইটা শিশু সন্তান আছে। আমি তাদের কিভাবে মানুষ করবো? আমি তো আর বাঁচবো না।'

বোয়ালিয়া থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজনকে আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। 

 এঘটনায় আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।