গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। কাটছে না ডলার সংকটও। নতুন এ পরিস্থিতিতে ব্যয় বাড়ছে শিল্পকারখানার। কমে যাচ্ছে উৎপাদনও। শিল্প খাতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে লিখেছেন চট্টগ্রামের রিজিওনাল এডিটর সারোয়ার সুমন

এক মাসেই বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর গ্যাসের দাম বেড়েছে গড়ে ৮২ শতাংশ। এর সঙ্গে ডলার সংকটে কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি। এসব কারণে বেড়ে যাচ্ছে শিল্পকারখানার ব্যয়। কমে যাচ্ছে উৎপাদন। অন্যদিকে নতুন রপ্তানি আদেশ পাওয়া নিয়েও শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। সব মিলিয়ে শিল্পকারখানার আকাশে এখন মেঘের ঘনঘটা। এ মেঘ যত দানা বাঁধবে বিপদ ততই বাড়বে। প্রভাব পড়বে সার্বিক অর্থনীতিতে।
পরিস্থিতির কিছুটা ইঙ্গিত মিলছে চট্টগ্রাম বন্দরে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের জেটিগুলো থাকছে ফাঁকা। বন্দরে কোনো পণ্যজট নেই। জাহাজজটও নেই। অথচ আগে বন্দরের বহির্নোঙরে থাকত অন্তত অর্ধশত জাহাজ। দুই থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত পণ্য খালাসের জন্য অপেক্ষা করতে হতো জাহাজকে। এখন সেই চিত্র দেখা যাচ্ছে না।

সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সংকটে আমদানি কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিলাসপণ্য আমদানিতে দেওয়া হয়েছে বিধিনিষেধ। শিল্পের পণ্য আমদানিতেও চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদার অর্ধেক ডলারও সরবরাহ করতে পারছে না ব্যাংক। এ জন্য কমে গেছে কাঁচামালের আমদানি। কমে গেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি। কমে গেছে পণ্যবাহী জাহাজের সংখ্যাও।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'গত দুই বছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তাই উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু এখন রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি নেই। সে কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণ কমে আসছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দীর্ঘমেয়াদে শিল্পের উৎপাদন, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে যেতে পারে।'

চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'দেশের শিল্পকারখানা এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একদিকে বিশ্বমন্দা, আরেকদিকে দেশীয় সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। বেকার হবেন হাজার হাজার শ্রমিক। এরই মধ্যে চট্টগ্রামে কয়েক ডজন শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।'

চট্টগ্রাম বন্দর পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে সচিব ওমর ফারুক বলেন, 'আগে জেটির জন্য অপেক্ষা করতে হতো জাহাজকে। আর এখন জাহাজের জন্য অপেক্ষা করে জেটি। কয়েকটি কারণে পরিস্থিতি একেবারে বিপরীত হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী পণ্যের বাজারে বিরাজ করছে অস্থিরতা। দেশে পণ্যের আমদানি কার্যক্রমে এসেছে নিয়ন্ত্রণ। বন্দরে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দ্রুত খালাস করে দিচ্ছে পণ্য। বন্দরে জট না থাকার এমন অনেক ফ্যাক্টর আছে।'
রপ্তানি আদেশ কমেছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে :গত বছরের শেষ মাসে ছিল রেকর্ড পরিমাণ রপ্তানি আয়। কিন্তু তারপরও চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে রপ্তানি আদেশ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, গত ডিসেম্বর মাসে রপ্তানি হয় ৫৩৬ কোটি ৫১ লাখ ডলারের পণ্য। ডলারের অঙ্কে একক মাস হিসেবে এটি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রপ্তানি। তারপরও শঙ্কায় আছি। কারণ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে রপ্তানি আদেশ কমছে আশঙ্কাজনক হারে। এই কমার হার গড়ে ৩০ শতাংশ হতে পারে। গত ডিসেম্বরে রেকর্ড রপ্তানি হলেও সেখানে কিন্তু পণ্যের পরিমাণে বা সংখ্যায় প্রবৃদ্ধি হয়নি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে অর্থের পরিমাণে।

উৎপাদন খরচ বাড়ায় উদ্বিগ্ন শিল্প মালিকরা : শিল্পকারখানায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন উদ্যোক্তারা। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক সুতা, তুলার দাম বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। যে কারণে বাড়ছে উৎপাদন খরচও।

তবে এ মুহূর্তে শিল্পোদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া। পোশাক খাতের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, আগামী কয়েক মাস কঠিন সময় যাবে শিল্পকারখানার। কারণ গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়েছে।

বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, শিল্প, বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহূত গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিটে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক মাসেই বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি মাসে গ্যাসের বাড়তি দাম যোগ হবে ৮২ শতাংশ।

পোশাক শিল্প মালিকরা বলছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা মানা হয়নি। ব্যবসায়ীরা শুধু ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যাসের দাম বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট ২৫ টাকা করার প্রস্তাব করলেও দাম বেড়েছে অনেক বেশি। গ্যাসের দাম বাড়ায় তাদের সামগ্রিক উৎপাদন খরচ ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

কমে গেছে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিও :সাধারণত মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করেন। ফলে এ পণ্যটির আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। চলতি বছরে ১০টি নতুন বস্ত্রকল উৎপাদন শুরু করার কথা। এতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন উদ্যোক্তারা। নতুন করে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা কয়েক হাজার মানুষের। সে হিসাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ার কথা দেশে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র।

ডলার সংকট ঠেকাতে আমদানি কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণপত্র খোলায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে রয়েছে কড়াকড়ি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কাও তীব্র হচ্ছে। তাই শিল্প স্থাপনের নতুন প্রকল্প, ব্যবসা সম্প্রসারণ, সংস্কারসহ নতুন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না ব্যবসায়ীর অনেকে। এ কারণে ক্রমে কমছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির হারও। গত জুলাই-আগস্ট মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি হয়েছে ২৬৬ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ কম।

কমছে উৎপাদন, বন্ধ হচ্ছে কারখানা :সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে চট্টগ্রামে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক কারাখানা। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয় ডিপস অ্যাপারেল ও ডিপস অ্যাপারেল এক্সটেনশন নামের দুটি কারখানা। ডিপস অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বাক্ষরিত এক ছাঁটাই নোটিশে বলা হয়, বর্তমানে নতুন কাজের অর্ডার না থাকায় কারখানা কর্তৃপক্ষ আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও কাজের অর্ডার সংগ্রহ করতে না পারায় শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজ দিতে অক্ষমতার কারণে কর্তৃপক্ষের পক্ষে কারখানা পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ শ্রম আইনের সংশ্নিষ্ট ধারা অনুসারে কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছাঁটাই সংক্রান্ত যাবতীয় পাওনাদি শ্রম আইন অনুসারে পরিশোধ করার কথা জানিয়ে সংশ্নিষ্ট সবাইকে গত ১২ ডিসেম্বর কারখানায় উপস্থিত হয়ে যাবতীয় পাওনা বুঝে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এভাবে নোটিশ দিয়ে গত তিন মাসে অন্তত এক ডজন কারখানা বন্ধ হয়েছে চট্টগ্রামে।