- বাংলাদেশ
- এক কক্ষে যমজ মেয়ে অন্য কক্ষে অচেতন মা
এক কক্ষে যমজ মেয়ে অন্য কক্ষে অচেতন মা
তিন দিন না খেয়ে মুমূর্ষু পড়েছিলেন নিজ ফ্ল্যাটে

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শাফানা
রাজধানী উত্তরার সেক্টর ৪, সড়ক ১৩। ২৮ নম্বর বাড়ির ২/বি-১ ফ্ল্যাট। ওই ফ্ল্যাটে থাকেন শাফানা আফিফা শ্যামী (৩৫), সঙ্গে ১০ বছরের দুই যমজ সন্তান ফাতেমা ও আয়েশা। তিন দিন ধরে ওই ফ্ল্যাটের কাউকে বাইরে যেতে না দেখে নিরাপত্তারক্ষীর মনে সন্দেহ জাগে। কলিং বেল বাজিয়েও কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে গত শনিবার মধ্যরাতে খবর দেন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসে।
রাত ৩টার দিকে পুলিশ এসে দরজা ভাঙে। তখন পুরো ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। ঘরে তিনটি খাট ছাড়া নেই কোনো আসবাব। ফ্রিজ-টিভি কিছু নেই। এক কক্ষে মিলল ফুটফুটে দুই শিশু ফাতেমা ও আয়েশাকে। জটলা বাঁধানো চুল, গোলাপি রঙের পোশাকে দু'জনই নিস্তেজ। আরেক কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সেই ঘরের দরজা ভেঙে পুলিশ বিছানায় আবিস্কার করল শাফানাকে। তখন তিনি অচেতন। মুমূর্ষু তিনজনকে পুলিশ উদ্ধার করে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করে।
রাতের ওই অভিযানে অংশ নেন উত্তরা থানার পরিদর্শক মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি সমকালকে জানান, ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে তাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় ফ্ল্যাট মালিক সমিতির লোকজনও উপস্থিত ছিলেন। ঘরের ভেতর তাঁরা মুমূর্ষু অবস্থায় ছিলেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক জানিয়েছেন, দীর্ঘ সময় অনাহারে থাকায় এ অবস্থা হয়েছে। ওই নারীও জানিয়েছেন, তিন দিন বাসায় কোনো রান্না হয়নি। বিল পরিশোধ করতে না পারায় কয়েক দিন আগে ওই ফ্ল্যাটের বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেওয়া হয়।
মুজাহিদ জানান, হাসপাতালে মা ও সন্তানদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পোশাক কেনা ও চিকিৎসার খরচ হিসেবে দেওয়া হয় কিছু টাকাও। গতকাল রোববার রাত ১২টা পর্যন্ত শাফানার কোনো স্বজন হাসপাতালে তাঁদের দেখতে যাননি।
শাফানার এক ভাই নাদিম খুলনায় থাকেন। এ ব্যাপারে গত রাতে সমকাল নাদিমের সঙ্গে কথা বলে। তিনি বলেন, 'শুনেছি বোন ও তাঁর দুই সন্তানকে উদ্ধার করা হয়েছে। অন্য ভাইদের বিষয়টি জানিয়েছি। বছরখানেক আগে সর্বশেষ বোনের সঙ্গে কথা হয়েছিল।'
উত্তরার ওই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মো. ফারুক বলেন, 'উদ্ধার করার সময় আমরা ছিলাম। হাসপাতালেও গেছি। এখন তাঁদের অবস্থা কিছুটা ভালো।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাফানার এক স্বজন জানান, শাফানার বাবা অ্যাডভোকেট আবদুল আলিম বুলবুল তিন বছর আগে মারা যান। তাঁদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। উত্তরার ওই বাড়িটি শাফানার বাবার। আইয়ুব খানের আমলে তাঁর দাদা মাওলানা আবদুল হাই এমএলএ ছিলেন। উত্তরার জমি শাফানার বাবা একটি ডেভেলপার কোম্পানিতে বহুতল ভবন তৈরি করতে দেন। যে ফ্ল্যাট থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি ওয়ারিশ সূত্রে পেয়েছেন শাফানা। ১০ বছর আগে একজন ব্যাংকারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের এক বছর না যেতেই অন্তঃসত্ত্বা থাকার সময় বিচ্ছেদ ঘটে। এর পর যমজ সন্তানের মা হন শাফানা। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বাবার উত্তরায় বাসায় ওঠেন। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ফ্ল্যাটে মা-বাবাসহ থাকতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর দুই সন্তাসহ থাকতেন। শাফানা কোনো চাকরি কিংবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
শাফানার ওই আত্মীয় আরও জানান, শাফানার দুই সন্তান ফাতেমা ও আয়েশা উত্তরার একটি ভালো স্কুলে পড়ত। আর্থিক সংকটের কারণে ওই প্রতিষ্ঠানে তাদের লেখাপড়া চালানো সম্ভব হয়নি। পরে আজমপুরে একটি স্কুলে ভর্তি করা হয়। সেখানেও তারা নিয়মিত যেত না। শাফানার সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যদের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। কেউ তাঁদের খোঁজও নিতেন না। মারা যাওয়ার আগে সামান্য কিছু টাকা মেয়ের জন্য ব্যাংকে রেখে যান শাফানার বাবা। আর গ্যারেজের ভাড়া হিসেবে মাসে সামান্য কিছু টাকা পেতেন। সংসার চালানোর জন্য এই টাকা যথেষ্ট ছিল না। মাসে ১০-১৫ হাজার টাকার সংস্থান তাঁর নেই। ভাইদের সঙ্গে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে তাঁর মতবিরোধ হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। নিজ ফ্ল্যাটের ইউটিলিটি বিলসহ কয়েক মাসের সার্ভিস চার্জও পরিশোধ করতে পারছিলেন না তিনি। তাঁর মা ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন। শাফানার আরেক স্বজনের ভাষ্য- মানসিক সমস্যায় ভুগছেন শাফানা। তিনি সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত।
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের চিকিৎসক মো. মামুন সমকালকে বলেন, দুই শিশুর মধ্যে একজন ও তাদের মা মানসিক রোগে ভুগছেন। দ্রুত তাঁদের মানসিক হাসপাতালে পাঠানো জরুরি। এখনও কোনো স্বজন হাসপাতালে না আসায় আমরা পাঠাতে পারছি না। সিজোফ্রেনিয়া এক ধরনের মানসিক রোগ। আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে নিশ্চিত হওয়া যাবে, তাঁরা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত কিনা। যখন হাসপাতালে আনা হয়েছিল, তখন তাঁরা শারীরিকভাবে দুর্বল ছিল। এখন মাঝেমধ্যে ওই নারী নিজের ইচ্ছায় টুকটাক কথা বলছেন।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি মোর্শেদ আলম বলেন, যে ফ্ল্যাটে সন্তানসহ ওই নারী থাকতেন, সেখানে মোবাইলসহ অন্য কোনো ইলেকট্রনিকস ডিভাইস পাওয়া যায়নি। অদ্ভুত পরিবেশে তাঁরা বাস করতেন। শনিবার মধ্যরাতে পুলিশ খবরটি পাওয়ার পর দ্রুত সেখানে ছুটে যায়। সন্তানসহ ওই নারীর চিকিৎসা চলছে। তাঁরা সবাই ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর ছিলেন।
মন্তব্য করুন