- বাংলাদেশ
- বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে কি
প্রস্তাবিত ডাটা সুরক্ষা আইন
বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে কি

সরকারের প্রস্তাবিত ডাটা (উপাত্ত) সুরক্ষা আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। তাঁরা বলছেন, এ আইনের খসড়ায় এমন বিধান রয়েছে, যা দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করবে। অনেক বহুজাতিক কোম্পানিকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। তবে সরকার বলছে, প্রস্তাবিত এই আইন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। দেশি-বিদেশি সব পক্ষের মতামত ও পরামর্শ নিয়েই এ আইন করা হচ্ছে। দেশীয় তথ্যের সুরক্ষার জন্য এই আইন। এতে বিদেশি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, দেশীয় তথ্যের সুরক্ষার পাশাপাশি এর অবাধ প্রবাহ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে আইন প্রণয়ন করা উচিত।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি) ডাটা সুরক্ষা আইন (ডিপিএ) প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। আইনটির খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবেদনশীল উপাত্ত, ব্যবহারকারীর সৃষ্ট উপাত্ত, শ্রেণিবদ্ধকৃত উপাত্ত শুধু বাংলাদেশ সংরক্ষণ করবে। খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, সরকার ঘোষিত শ্রেণিবদ্ধকৃত উপাত্ত সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া অন্য কোথাও স্থানান্তর করা যাবে না। খসড়াটি বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের জন্য (ভেটিং) পাঠানো হয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গত ২৬ জানুয়ারি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আইনের খসড়া নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যেই এটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে।
গত রোববার ঢাকায় 'অনলাইন ফ্রিডম অ্যান্ড বিজনেস ইনভেস্টমেন্ট ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে প্রস্তাবিত ডাটা সুরক্ষা আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। তিনি বলেন, এই আইন পাস হলে দুই হাজারের বেশি স্টার্টআপ ব্যবসা ছেড়ে দিতে পারে। তিনি বলেন, এ আইনে যদি ডাটা স্থানীয়করণের প্রয়োজনীয়তাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার শর্ত দিয়ে অনুমোদন করা হয়, তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে এমন অনেক আমেরিকান কোম্পানি এ দেশের বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি কোম্পানিগুলোকে ব্যবহারকারীদের তৈরি করা কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর কারণে অপরাধের দায় নিয়ে ফৌজদারি আইনের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে তারা এখানে তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে। এর পরিণতি বাংলাদেশের জন্য খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, আইনের সর্বশেষ খসড়ায় একটি স্বাধীন ডাটা তদারকি কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা রাখা হয়নি এবং এ আইনে ফৌজদারি শাস্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ভিয়েতনামের সরকার গত বছর তথ্য সুরক্ষা-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করে। এতে বলা হয়, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলোকে ভিয়েতনামের নাগরিকদের সংগৃহীত উপাত্ত সে দেশেই সংরক্ষণ করতে হবে। আইন করার পর ফেসবুক, গুগলের মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন ফাউন্ডেশন (আইটিআইএফ) গত ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে বলেছিল, প্রস্তাবিত ডাটা সুরক্ষা আইন বাংলাদেশের প্রযুক্তি রপ্তানি বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে। এতে আরও বলা হয়, ডাটা স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ নীতি বাস্তবায়ন হলে পাঁচ বছরে বাংলাদেশের প্রযুক্তি বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৬ শতাংশ কমবে।
এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির সমকালকে বলেন, ডাটা সুরক্ষা আইনের খসড়ায় কিছু বিষয় রয়েছে, যা বহুজাতিক বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানির জন্য উদ্বেগজনক। এসব প্ল্যাটফর্ম তৃতীয় পক্ষের যেসব কনটেন্ট সংরক্ষণ করে, তার দায় নিতে চায় না। কিন্তু খসড়ায় তাদের দায়ী করা যাবে- এমন বিধান রয়েছে। তিনি বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বাংলাদেশিরা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। তাই তাঁদের উদ্বেগ অবশ্যই আমলে নিতে হবে। সম্প্রতি ভারত এসব কোম্পানির দাবির মুখে ডাটা সুরক্ষা আইন প্রণয়ন থেকে পিছিয়ে গেছে। সুমন আহমেদ বলেন, দেশীয় তথ্যেরও সুরক্ষা প্রয়োজন। তাই আইনটি এমন হওয়া উচিত, যাতে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক হয়।
জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে নিজেদের তথ্যের সুরক্ষা দেওয়ার অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে। সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন আইন রয়েছে, সেসব দেশে কি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসা করছে না? তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ দেখবে, বাংলাদেশও তার জনগণের তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
খসড়া ডাটা সুরক্ষা আইনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইলে নাম না প্রকাশ করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। তবে খসড়া ডাটা সুরক্ষা আইনের কোন বিষয়টিতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানানো হয়নি।
বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আমাদের অবস্থান খুবই পরিস্কার। কোনো আইন করা হলে সেটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে দেশি যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, তা মাথায় রেখে করা হয়। ফলে এখানে কারও কোনো সুপারিশ থাকলে তা বিচার-বিশ্নেষণ করা হয়। বন্ধু রাষ্ট্রের কোনো বিষয়ে কোনো সুপারিশ থাকলে তা বিবেচনা করা হবে। তবে তা হতে হবে সুনির্দিষ্ট ও গঠনমূলক।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল হক গত ২৬ জানুয়ারি সাংবাদিকদের বলেছেন, তথ্য সুরক্ষা আইন তথ্য সুরক্ষার জন্য প্রণীত হচ্ছে। আইন পাসের আগে সব স্টেকহোল্ডারের কথা শোনা হবে।
প্রস্তাবিত আইনের নানা আলোচনা-সমালোচনা প্রসঙ্গে জুনাইদ আহমেদ পলক সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আইনটি নিয়ে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা থেকে যেসব আপত্তি এসেছে, সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংশোধিত আকারে যুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডাটা সুরক্ষার যেসব নীতি রয়েছে- সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকে যেসব পরামর্শ এসেছে, সবকিছুর ভিত্তিতেই আইনটি চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন