বার্ধক্যজনিত নানা রোগশোক মাঝেমধ্যে শরীরে ভর করে ৭২ বছরের সালেহা মনিরের। প্রায়ই রক্তচাপ ওঠানামা করে। এর পরও প্রতিদিনের প্রার্থনায় তাঁর একটাই চাওয়া- মরণের আগে যেন প্রিয় সন্তান ও পুত্রবধূর হত্যার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত ও বিচার হয়। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার পাবেন- এই বিশ্বাস কখনও পুরোপুরি হারাননি সালেহা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সাগরের মা সালেহা মনির সমকালকে বলেন, 'মিরাকল কিছু ঘটনার অপেক্ষায় আছি। ২০-৩০ বছর পরও তো দেখি কোনো কোনো মামলার রহস্য বের হয়। হয়তো অলৌকিকভাবে ওদের ক্ষেত্রে সেটা ঘটবে। আশা রাখতে চেয়েও আবার কখনও কখনও আশাহত হয়ে পড়ি। ওপরওয়ালার ওপর বিচার ছেড়ে দিলাম।'

তিনি আরও বলেন, 'র‌্যাব তদন্তে কিছু না পেলে ছেড়ে দিক। ঝুলিয়ে রাখবে কেন। সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার রহস্য ৩০ বছর পর বের হয়েছে। সেটা পিবিআই পেরেছে। আমি চাই পিবিআইকে সাগর-রুনি হত্যা মামলার দায়িত্ব দেওয়া হোক। তারা চেষ্টা করে দেখুক।'

প্রায় ৩০ বছর পর নাটকীয়ভাবে উন্মোচিত হয়েছে সগিরা মোর্শেদ সালাম নামে এক নারীর হত্যারহস্য। ২০১৯ সালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের এক দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকেলে সগিরাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই দিন রিকশায় করে যাওয়ার পথে তাঁর স্বর্ণালংকার ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে বাধা পেয়ে গুলি করে দু'জন। দীর্ঘদিন পর বেরিয়ে আসে এ ঘটনাটি ছিনতাই নয়, ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যার নেপথ্যে ছিল পারিবারিক দ্বন্দ্ব।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন সাগর ও রুনি দম্পতি। আগামীকাল শনিবার এই হত্যাকাণ্ডের ১১ বছর পূর্ণ হবে। দেশের ইতিহাসে অন্যতম চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মামলার তদন্ত করছে র‌্যাব। আগামী ৫ মার্চ এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নতুন তারিখ ধার্য রয়েছে। এখন পর্যন্ত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আদালত ৯৫ বার সময় দিয়েছেন। তবে তদন্তসংশ্নিষ্ট র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, মামলার প্রতিবেদন জমা দেওয়ার মতো সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত এখনও পাওয়া যায়নি। রহস্যভেদ করতে আন্তরিকতার সঙ্গে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন আলামতের বিশ্নেষণ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো ডিএনএ নমুনার প্রতিবেদনও পেয়েছে র‌্যাব। তবে সন্দেহভাজন কারও সঙ্গে এখনও ডিএনএর নমুনা মেলেনি।

এদিকে সাগর-রুনি হত্যাকাে রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। এর পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দ্রুত প্রতিবেদন দিতে র?্যাবকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। আমরাও চাই এ হত্যার রহস্য দ্রুত উন্মোচিত হোক।
এ ব্যাপারে র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, শুরু থেকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই আলামত যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। নির্দোষ কেউ হয়রানির শিকার হোক এটা চাই না। ক্লু শনাক্তে নানা দিক বিশ্নেষণ করে দেখা হচ্ছে। নিহতের পরিবার থেকে মামলটি পিবিআইর কাছে ন্যস্ত করার দাবি উঠেছে-

এ ব্যাপারে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, মামলা অন্য ইউনিটে স্থানান্তরের বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। যদি পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই অনুমতি দেন, তাহলে সেখানে যাবে।
সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে এই মামলা তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। চার দিন পর মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে ন্যস্ত হয়। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এর পর আদালত র?্যাবকে মামলা তদন্তের নির্দেশ দেন। সাগর সরওয়ার মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। মেহেরুন রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। হত্যাকাে র সময় বাসায় ছিল তাঁদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ। সাংবাদিক দম্পতির একমাত্র ছেলে মেঘ রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে 'ও' লেভেল পড়ছে।

মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের আলম বলেন, 'আমরা তো বিচার চাই। এখনও বিচার পেলাম না। খুনি কারা জানতে পারলাম না। সন্তান হারানোর কষ্টে এক বছর আগে মাও মারা গেলেন। মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে হারিয়ে মা শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন। মেঘের একটি ভরসার জায়গা ছিল নানু। এখন মেঘকে আমি দেখভাল করছি।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, কিছু কিছু মামলা থাকে যা দীর্ঘদিন সুরাহা করা যায় না। সাগর-রুনি হত্যারও রহস্য বের করা যায়নি। এই ধরনের পুরোনো অনেক মামলা মনিটরিং সেলে থাকে। কিছু পাওয়া না গেলে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়। সেখানে লেখা থাকে কখনও ক্লু পাওয়া গেলে এই মামলার তদন্ত নতুনভাবে শুরু হবে।

র‌্যাবের আগেও যেসব কর্মকর্তা সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন দু'জনের সঙ্গে কথা হয় সমকালের। তাঁদের ভাষ্য, সাংবাদিক দম্পতি হত্যা মামলার তদন্ত একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় তাঁরা নিতে পারতেন, যদি বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া আলামত উদ্ধার করতে পারতেন। ওই বাসা থেকে নেওয়া ল্যাপটপসহ অন্যান্য আলামত তাঁরা জব্দ করার চেষ্টা করেছেন। তবে কোথায় এসব রয়েছে, সেটা তাঁরা বের করতে পারেননি।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, 'তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।' ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, 'মোটিভ' নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে কেটে গেছে ১১ বছর। এক দশকেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

হত্যাকাে র ৭৬ দিনের মাথায় ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলন করা হয় সাগর-রুনির লাশ। ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো ডিএনএ আলামতের নমুনা প্রতিবেদনে কারও চেহরার অবয়ব পাওয়ার কথা ছিল। তবে আলামত থেকে সেই ধরনের কিছু এখনও পাওয়া যায়নি।


বিষয় : অপার্থিব কিছুর অপেক্ষায় মা

মন্তব্য করুন