৫ সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় একমাত্র উপার্জনক্ষম দিনমজুর মো. হান্নান মিয়ার। কাজ জুটলে খাবার জোটে। সংসারের এমন হালে তিন মেয়ের পড়াশোনা করানোর দুঃসাহস দেখান তিনি। তবে অভাবের সংসারে পেরে ওঠা দায়। তাই পড়াশোনা চালিয়ে নিতে বড় মেয়ে শুরু করে বাচ্চাদের পড়ানো। সেখান থেকে যে টাকা আসে তা দিয়ে নিজের পড়ালেখা ও অন্যান্য খরচের পাশাপাশি বাবার অভাবের সংসারে সহযোগিতায় করতো নিশাত। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিশাত চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করে। তবুও অনিশ্চিত উচ্চশিক্ষা।

এই অদম্য মেধাবী ছাত্রীর বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায়। সে উপজেলার লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ অর্জন করে। 

তার এই সংগ্রামী জীবনের বিষয়ে কুলাউড়ার লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগ মুহূর্তে হতাশ হয়ে পড়েছিল। সে একদিন বলছিল, স্যার আমার ঘরে খাবার নেই। বাবা বেকার! কী করব? পরীক্ষা দেবে না। উত্তরে আমি বললাম, শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছো, বেঁচে তো আছো, পরীক্ষা দাও ভালো করে। এখন থেকে প্রস্তুতি নাও, সংগ্রাম করে যাও। প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আলো নিহিত আছে। সব প্রতিবন্ধকতা দূরে সে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার এই ফলাফলে আমি গর্বিত।’ 

উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের গুতুমপুর গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর মো. হান্নান মিয়া ও গৃহিণী নাজমা বেগমের দম্পতির তিন মেয়ের মধ্যে নিশাত সবার বড়। সে স্থানীয় রাঙ্গিছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসিতে জিপিএ ৩ দশমিক ৭৮, লক্ষ্মীপুর মিশন উচ্চবিদ্যালয় থেকে জেএসসিতে ৪ দশমিক ৫০ ও এসএসসিতে ৪ দশমিক ৫০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। নিশাতের দুই বোনের মধ্যে আয়েশা আক্তার লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণী ও ছোট বোন মাইশা আক্তার লক্ষ্মীপুর মিশন উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। 

নিশাত জানায়, প্রতিদিন ৮-৯ ঘণ্টা পড়ালেখা করতো সে। অভাব-অনটনের সংসারে টাকার জন্য কোনদিন প্রাইভেট পড়া হয়নি। পরিবারের বাবা-মা ও শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় তার এ সাফল্য এসেছে। প্রাইমারি থেকে কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা করতে তাকে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছে। পড়াশোনা চালিয়ে নিতে সে টিউশনি করতো। টিউশনির টাকায় পড়ালেখা ও বাবাকে সহযোগিতা করতো। 

নিশাত বলে, ‘আমি এখন আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চাই। সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য একটা কিছু করতে চাই। আমার বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’

নিশাতের বাবা দিনমজুর হান্নান মিয়া বলেন, ‘দিনমজুরের কাজ করে কোনমতে সংসার চালাই। ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে তিন মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছি। যখন যে কাজ পাই তখন সেটা করি। তারপরও তিন মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করিনি। আমার মেয়ের ইচ্ছে, সে আইন বিষয়ে পড়তে চায়। কিন্তু বাবা হিসেবে তার উচ্চশিক্ষার জন্য এত টাকা খরচ করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। যদি সরকার কিংবা সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসেন, তাহলে আমার মেয়ের স্বপ্ন বাস্তবে পূরণ হবে।’ 

লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আতাউর রহমান বলেন, নিশাত আমাদের কলেজের অদম্য একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। সে পড়াশোনায় খুবই মনোযোগী। যদি সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠান নিশাতের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে সে একদিন ভালো আইনবিদ হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করবে।