২০১৮ সালে ঢাকার শিক্ষার্থীদের একটি আন্দোলন নাড়া দেয় পুরো দেশকে৷ ওই খবর পৌঁছে যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ঘটনার শুরু সেই বছরের ২৯ জুলাই৷ ওই দিন রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় মারা যায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম মীম ও আবদুল করিম রাজীব। ঘটনার দিনই তাদের সহপাঠীরা রাস্তায় নামে। নয় দিনের সেই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল নয়টি। একটি দাবি ছিল, রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল এবং লাইসেন্স ছাড়া চালকদের গাড়ি চালনা বন্ধ করা। আর এসব দাবি বাস্তবায়নে আইন সংশোধন করে 'সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮' জাতীয় সংসদে পাশ হয়। আইন পাশের চার বছর পূর্ণ হলেও তা বাস্তবায়নে বিধিমালা জারির বিষয়টি ঝুলে থাকে। অবশেষে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর জারি হয় সেই বিধিমালা। এরপর থেকে আইন বাস্তবায়নে কোনো বাধা না থাকলেও সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ হয়নি। সড়কে থামছে না মৃত্যু। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ভিক্টর পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাদিয়া সুলতানার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। বাসটি জব্দ করলেও পুলিশ এখনও দায়ীদের গ্রেপ্তার করতে পারনি। ক্ষতিপূরণ পায়নি ওই শিক্ষার্থীর পরিবার। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিধিমালা জারির সাড়ে চার মাস পেরিয়ে গেছে, তবু আইনটির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পরিবহন মালিকদের চাপে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আইন বাস্তবায়নে কঠোর হয় না। তাদের আরেকটি অভিযোগ হলো, নিরাপদ সড়কের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিষয় আইন ও বিধিতে আসেনি। 

সড়ক পরিবহন আইনে যা আছে

১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ কার্যকর করার জন্য ২২ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এরপর বিআরটিএ থেকে আইনটি কার্যকর করতে সকলের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এ মোটরযান চলাচলের নির্দেশাবলী দেওয়া হয়েছে। এ আইনের ৪৯ ধারায় প্রথম অংশে বলা হয়েছে, মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো চালক মোটরযান চালাতে পারবে না। মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিক মোটরযানে অবস্থান করতে পারবে না। মোটরযান চালক কোনো অবস্থাতে কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিককে মোটরযান চালনার দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে না। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত অভিমুখ ব্যতীত বিপরীত দিক হতে মোটরযান চালানো যাবে না। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে বা উল্টো পাশে বা ভুল দিকে মোটরযান থামিয়ে যানজট বা অন্য কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। চালক ব্যতীত মোটর সাইকেলে একজনের অধিক সহযাত্রী বহন করা যাবে না এবং চালক ও সহযাত্রী উভয়কে যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। চলন্ত অবস্থায় চালক, কন্ডাক্টর বা অন্য কোনো ব্যক্তি কোনো যাত্রীকে মোটরযানে উঠাতে বা নামাতে পারবে না। প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য গণপরিবহনে অনুকূল সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে। মোটরযানের বডির সামনে, পিছনে, উভয়পার্শ্বে, বডির বাইরে বা ছাদে কোনো প্রকার যাত্রী বা পণ্য বা মালামাল বহন করা যাবে না। সরকার বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত কোনো মোটরযানে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বা প্রচার করা যাবে না। কোনো মহাসড়ক, সড়ক, ফুটপাত, ওভারপাস বা আন্ডারপাসে মোটরযান মেরামতের নামে যন্ত্রাংশ বা মালামাল রেখে বা দোকান বসিয়ে বা অন্য কোনভাবে দ্রব্যাদি রেখে যানবাহন বা পথচারী চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। সড়ক সংলগ্ন ফুটপাতের উপর দিয়ে কোনো প্রকার মোটরযান চলাচল করতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি কোনো মোটরযানের মালিক বা কোনো আইনানুগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত সংশ্লিষ্ট মোটরযান চালিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না। আইনানুগ কর্তৃপক্ষ বা যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত কোনো ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মোটরযানে প্রবেশ বা আরোহণ করতে পারবে না।

দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, মোটরযান চালক মোটরযান চালনারত অবস্থায় মোবাইল ফোন বা অনুরূপ সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবে না। মোটরযান চালক সিটবেল্ট বাঁধা ব্যতীত মোটরযান চালাতে পারবে না। দূরপাল্লার মোটরযানে নির্ধারিত সংখ্যক যাত্রী বা আরোহীর অতিরিক্ত কোনো যাত্রী আরোহী বহন করা যাবে না। কোন চালক, কমান্ডার বা মোটরযান পরিচালনার সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি পরিবহনযানে যাত্রী সাধারণের সাথে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার বা অসৌজন্যমূলক আচরণ বা হয়রানি করতে পারবে না। রাত্রি বেলায় বিপরীত দিক হতে আগত মোটরযান চালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এরূপ হাইবিম ব্যবহার করে মোটরযান চালানো যাবে না।

উপরোক্ত নির্দেশাবলী অমান্য করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রথম অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৩ (তিন) মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তন হবে। দ্বিতীয় অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ১ (এক) মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তন হবে। নতুন আইনে বেপরোয়া বা অবহেলায় গাড়ি চালানোর কারণে কেউ গুরুতর আহত বা কারো প্রাণহানি হলে অপরাধীর সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইনে বলা আছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হত্যার উদ্দেশ্যে প্রমাণিত হলে তা দন্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩০২ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে। সড়কে দুটি গাড়ি পাল্টা দিয়ে (রেসিং) চালানোর সময় যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। চলন্ত অবস্থায় চালক মুঠোফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এই আইনে অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে।

আইন প্রয়োগের নির্দেশনা জারির পর পুলিশের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, যারা আইন লঙ্ঘন করছেন, ট্রাফিক সার্জেন্টরা তাদের বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে মামলা করতে পারছেন না। কারণ বিধিমালা জারি হয়নি। 

বিধিমালাতে গলদ

যে বিধিমালার কারণে এতদিন আইন বাস্তবায়ন ঝুলে ছিল সেই বিধিমালাতেই রয়েছে গলদ। ২৭ ডিসেম্বর জারি হওয়া ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২’ অনুয়ায়ী, চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকলে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে ৩ লাখ টাকা। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে ১ লাখ টাকা। ক্ষতিপূরণের দাবিগুলো ১২ সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। আর্থিক সহায়তা পাওয়ার জন্য ফরম অনুযায়ী দুর্ঘটনা ঘটার সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদন দাখিল করার তারিখ থেকে ১০ দিনের মধ্যে বোর্ডের চেয়ারম্যান অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন। এই কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন বোর্ডের কাছে জমা দেবে।

প্রতিবেদন দাখিলের ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ড আবেদন মঞ্জুরপূর্বক আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিআরটিএর চেয়ারম্যান এই বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন। আর্থিক সহায়তার টাকা আবেদনকারীর ব্যাংক হিসাবে 'প্রাপকের হিসাবে প্রদেয়' চেকের মাধ্যমে দিতে হবে।

এদিকে চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শ্রেণির মোটরযান চালাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গণপরিবহন চালাতে অনুমতিপত্র (পিটিএ) এবং কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার নিয়োগের ক্ষেত্রে কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার লাইসেন্স থাকতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া গণপরিবহনে চালক, কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ডোপটেস্ট সনদ থাকতে হবে। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০০৬ সালের ৪২ নম্বর আইন) অনুযায়ী নির্ধারিত বেতন ও আর্থিক সুবিধাদি দিতে হবে। ২০ বছরের কম বয়সী কোনো ব্যক্তি কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার লাইসেন্স নিতে পারবে না বা এমন কোনো ব্যক্তির কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজারের লাইসেন্স মঞ্জুর করা যাবে না বলা হয়েছে বিধিমালায়। মোটরযানে রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি ব্যবহার করার বিষয়ে বলা হয়েছে, বাস বা মিনিবাসে চালক ছাড়া প্রত্যেক যাত্রীর আলাদাভাবে শ্রবণের জন্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস স্থাপন করা যাবে। তবে জনগণের বিরক্তি সৃষ্টি হয় এমন কোনো রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি কোনো মোটর কার, জিপ ও মাইক্রোবাসে চালানো যাবে না।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক পরিবহন বিধিমালা জারি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু বিধিমালায় কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা মোর্চা রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ বলেছে, বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিমালাটি মূলত পরিবহন আইন ও ব্যবস্থাসংক্রান্ত। এটা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যথেষ্ট নয়। নিরাপদ সড়কের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু বিষয় আছে, যা বিদ্যমান আইন ও বিধিতে আসেনি। তাই নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আলাদা অধ্যায় বা আইন প্রণয়ন করতে হবে।

তিনি বলেন, জাতিসংঘের সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ২০২১-৩০-এ বর্ণিত পাঁচটি পিলার—নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং দুর্ঘটনা–পরবর্তী ব্যবস্থার আলোকে বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা প্রণীত হয়নি। এ ছাড়া সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উল্লেখিত সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্যও আইন ও বিধিমালা করা হয়নি। আইন বা বিধিতে সড়ক অবকাঠামো, যানবাহনের নিরাপত্তা, সিটবেল্ট, শিশুনিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। নেশাগ্রস্ত ও মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোসংক্রান্ত বিষয়ে স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ নেই। দুর্ঘটনা–পরবর্তী আহত ব্যক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসনসংক্রান্ত কোনো বিধান উল্লেখ হয়নি। দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে সহযোগিতার বিষয়ে সেবা প্রদানকারীদের আইনি সুরক্ষার বিষয়টি নেই।

বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ক্ষতিপূরণের যে অর্থ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা একেবারেই কম। যে প্রক্রিয়ায় ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলা আছে, তা–ও জটিল। ট্রাস্টি বোর্ডের কোনো শাখা হবে কীনা, বিধিমালায় তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। তাই এক জেলার বাসিন্দা অন্য জেলায় দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তার ক্ষতিপূরণের বিষয়ের সুরাহা জটিল হয়ে যাবে বলে মনে করেন সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় গিয়ে যখন দুর্ঘটনার শিকার হবেন, তখন কে তাকে চিনবে? অন্য জেলায় গিয়ে ক্ষতিপূরণের জন্য দেনদরবার করতে যে ব্যয়, সেটাই বা বহন করবেন কীভাবে? যদি এমন হয়, কোনো নারী তাঁর স্বামী ও সন্তান উভয় হারিয়েছেন দুর্ঘটনায়, তাহলে একা তিনি ভিন্ন জেলায় গিয়ে এই অর্থের জন্য কত দিন তদবির করতে পারবেন?

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটি) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, জীবনের মূল্য অর্থ দিয়ে পূরণ করা যায় না। এত দিন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো অধিকার ছিল না। এই বিধিমালায় তা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রয়োজনে ট্রাস্টি বোর্ডের শাখা বাড়ানো যাবে। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সড়ক পরিবহনের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের কারণে এক বা দুটি পয়েন্ট কেটে নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। পুলিশ কীভাবে সেই পয়েন্ট কাটবে, তা–ও পরিষ্কার করা হয়নি।

বিধিমালা-আইন কাগজে আছে মাঠে নেই

বিধিমালা জারির পরও নতুন আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ের পুলিশের বিধিমালা সম্পর্কে ধারণাও নেই বলেন জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ট্রাফিক সার্জেন্ট। তারা বলেন, আইন-বিধিমালা করা হলেও সে অনুযায়ী তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। নেই আপডেট যন্ত্রও। যারা আইন লঙ্ঘন করছেন, ট্রাফিক সার্জেন্টরা তাদের বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে মামলা করতে পারছেন না। কারণ, তারা যে ডিজিটাল যন্ত্রের (পজ মেশিন) সাহায্যে মামলা করবেন, সেটির সফটওয়্যার হালনাগাদ করা হয়নি। কাগজের স্লিপের মাধ্যমে মামলা করার রসিদবইও তাদের কাছে সরবরাহ করা হয়নি। 

এ বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, বিধিমালা জারির আগেই আইন বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্টরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এক দিনেই সব সম্ভবন নয়। ধীরে ধীরে সব করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একজন উপসচিবের নেতৃত্বে নতুন সড়ক নিরাপত্তা শাখা গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এই শাখা সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখবে। ৬০ টাকা ফিতে ঘরে ঘরে ড্রাইভিং লাইসেন্স পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। এজন্য ডাক বিভাগের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়।  ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে এখন আর চালকদের বিআরটিএ কার্যালয়ে আসার প্রয়োজন নেই। মোবাইলে প্রথমে কার্ড পাঠিয়ে দেওয়া হবে। পরে সরকারি ডাকযোগে কার্ড পৌঁছে যাবে। এতে অনিয়ম-দুর্নীতি কমবে।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা আন্তরিক না হলে কাজ হবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও যে সাজেশনগুলো দিয়েছেন যে, এগুলো করো৷ সেগুলোরই কাজ হচ্ছে না৷ এই যে কাজ হচ্ছে না, এই কাজ যাদের করার কথা, তারা কাজ না করলে তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না৷ এই কাজ না করার জন্য তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হচ্ছে না৷ তাদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না৷ যারাই দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক, তারা যতদিন পর্যন্ত জবাবদিহিতার মধ্যে না আসবে, ততদিন পর্যন্ত দুর্ঘটনা কমানো যাবে না৷

তিনি বলেন, বেশির ভাগ মামলার আসামি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে তদন্ত সংস্থা। ঘটনার শিকার পরিবারের লোকজন যদি বিচার পেত, তাহলে এত দুর্ঘটনা ঘটত না।

গ্লোবাল রোড সেইফটি এডভোকেসি ও গ্রান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাইফুর রহমান বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে এতদিন আইন দুর্বল ছিল, আবার তা প্রয়োগও কম হতো। এবার আইন সংশোধন হয়েছে, বিধিও জারি হয়েছে। কিন্তু সেই বিধিতে কিছু সংশোধনের সুপারিশ আমরা করেছি। সংশোধিত আইন ও বিধি যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব।