- বাংলাদেশ
- 'আমার মুখ বন্ধ ছিল না আমার লেখা বন্ধ ছিল না'
প্রচ্ছদ
'আমার মুখ বন্ধ ছিল না আমার লেখা বন্ধ ছিল না'

আমাকে এই বিশেষ সম্মাননা দেওয়ার জন্য প্রধান অতিথি, সমকাল ও ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই। এ সম্মাননার জন্য আমি অত্যন্ত গর্বিত। আগামী মাসে আমি ৮৮ বছরে পৌঁছাব। এ বয়সে এমন সম্মাননা বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। সম্মাননাটিকে 'আজীবন সম্মাননা' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমি এর আগেও এমন কিছু পুরস্কার পেয়েছি। সেখানেও আমি বলেছি, এখনও বলছি- আমাকে ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কৃত করাটা সেই মানুষদের প্রতি কিছুটা অবিচারই করা হবে, যাঁদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। কারণ, আমি যা অর্জন করেছি, যার জন্য আজ আমাকে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে, অনেকের সম্মিলিত প্রয়াসেই তা সম্ভব হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কথা বলা যেতে পারে। সে সময় আমরা তৎকালীন অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে কাজ করে দেখিয়েছি- পাকিস্তান রাষ্ট্রে দুই ধাঁচের অর্থনীতি রয়েছে। এ ধারণাটি আমার মৌলিক বা একক বিষয় ছিল না। আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও এ ধারণার বাহক ছিলেন। একইভাবে অ্যাকটিভিস্ট চরিত্রের কথাও বলা যায়, যেখানে আমার শিক্ষার্থীরাসহ ব্যাপক পরিসরে জনগণের সঙ্গে আমার সংযোগ ঘটেছে।
তখন আইয়ুব আমলে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি নিয়ে একটি লেখা লিখতে বলা হয় আমাকে। অর্থনৈতিক বৈষম্যকে কেন্দ্র করে আমি লিখেছি। বই প্রকাশের পর আমার লেখাটা সরকারের নজরে এলো। এরপর পুরো বই উঠিয়ে নেয় সরকার। এরপর আমার লেখা বাদ দিয়ে অন্য একজন আর্থনীতিবিদের লেখা যুক্ত করে রিপ্রিন্ট করা হয়। ওই সময়ই তো আমার কাছে পরিস্কার হয়ে যায় যে, সংগ্রাম তো একটা চলছেই। তখন সামরিক আইন চলছে। গণপরিসরে মানুষ এভাবে কথা বলছিল বা লিখছিল না। আমি লিখলাম। পাকিস্তান অবজারভার আমার লেখার ছাপ দিয়ে প্রকাশ করল। তখন আমি রাজনৈতিক নেতাদের নজরে আসি। সেই সঙ্গে সরকারের নজরেও আসি। যখন বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রকাশ করলেন, যেখানে আমার অর্থনৈতিক ফলাফল উঠে এসেছে; তখন আমার একটা প্রচারণা হলো, আমাকে অনেকেই চিনল।
স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার বিরল সুযোগ আমার হয়েছিল। সেখানে ভীষণভাবে তাঁদের অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। অসাধারণ মানবিক গুণের অধিকারী বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ছিল ক্যারিশম্যাটিক। সেইসঙ্গে ছিল তাজউদ্দীন আহমদের অনন্য বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্নেষণাত্মক দক্ষতা। এগুলো আমাকে শুধু নতুন দীক্ষাই দেয়নি; আমার কাজের ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে উঠেছে, তাকে সক্ষম করে তুলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাস আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থনৈতিক বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত দূত হিসেবে কাজ করেছি। সে সময় বাংলাদেশ সরকারের বার্তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে বহু মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের বিপরীতে আমাদের এ প্রচার অভিযান ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নুরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান ও আমাকে অধ্যাপক মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা কমিশন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। প্রথম বছরেই আমরা প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ শুরু করি। আমাদের থেকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তিধরদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করি, যাদের মুক্তিযুদ্ধে সমালোচনামূলক ভূমিকা ছিল। এ সবই অর্জিত হয়েছে যৌথ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।
পরবর্তীকালে আমি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এরপর ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ প্রতিষ্ঠার সময়েও আমি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এ সবই একেকটি যৌথ প্রচেষ্টা।
আমি বহু বছর ধরে দেখছি, এমন কোনো আয়োজন নেই যেখানে একটি গোটা প্রজন্মকে সংবর্ধনা জানানো হয়, যাঁরা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন, আর পরের ৫০ বছর ধরে দেশ গড়ার কাজ করে গেছেন। আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুরস্কার পাই। আমরা এর প্রশংসা করি। তবে আমি এ সম্মাননা আমার বিভিন্ন পর্যায়ের সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। আমি যা অর্জন করতে পেরেছি, সেটি তাঁদের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তবে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। আমার প্রয়াত স্ত্রী সালমা সোবহান; আমার বর্তমান সঙ্গী অধ্যাপক রওনক জাহান, যিনি সেই বিষয়গুলো, যেগুলো নিয়ে আমি ইতোমধ্যে কাজ করে ফেলেছি, তা নিয়ে আমার চেয়ে অনেক সুন্দরভাবে বলতে পারেন। জীবনের অনিশ্চয়তা, হতাশা; জীবনের প্রথম ভাগে আসা অস্থিরতা, যখন ভবিষ্যৎ থাকে অজানা- আপনজনদের কাছ থেকে পাওয়া শক্তি ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। আমি অনুভব করি, তাঁদের বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
আজ আপনারা আমাকে যে পর্যায়ে দেখছেন, যেখানে আমাকে কিছু সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে- আমার নিজের জীবনের লক্ষ্য তেমনটা ছিল না। আমরা বেড়ে উঠেছি এক সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারে। আমার সমকাতারের লোকজন বিলাসবহুল জীবন কাটিয়ে দেওয়াকেই বেছে নিতেন, যে সুযোগ তাঁদের রয়েছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। ১৯৫৯ সালে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে চলে আসি। আমার জমানো আবেগ, নিজের জীবন এবং যেসব সীমাবদ্ধ দক্ষতা আমি অর্জন করেছি, তা দেশের সংগ্রামে ব্যয় করার জন্য আমি প্রথমবারের মতো দেশটিকে নিজের ঘর বানাতে চলে আসি। অর্থনীতির ভাষায় প্লট লিনিয়ার গ্রাফের কথা বলা যেতে পারে, যেখানে আমার জীবন শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে কোনোভাবে আমার জীবনের শেষটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। তবে জীবনের প্রতিটি স্তরই ভীষণ জটিল ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি যুক্ত হওয়া। আমি যখন শিক্ষকতায় যুক্ত হলাম, বেশিরভাগ শিক্ষকই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিতর্ক করতেন, এ নিয়ে তাঁরা লিখতেন, যা কখনোই শাসকরা ভালোভাবে নিত না। সাধারণভাবে এটি মনে করিনি যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি প্লাটুন ঘরে ঢুকে পড়বে, যেমনটা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বিকেলে তারা করেছে। সেদিন তারা আমায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিযোগে আটক করে। সাধারণ শিক্ষকরা এমনটা যে হতে পারে সেটিও ভাবতেন না। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল, আমি ঘর থেকে বের হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি অংশ নিতে পেরেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মী তা করতে পারেননি। তাঁরা চরম মূল্য চুকিয়েছেন। যে ঘটনায় এখনও আমরা মর্মাহত হই, শোক পালন করি।
আমি যে এই পথে যাব, তা কখনোই আমার চিন্তায় ছিল না। চিন্তা ছিল- আমি আমার জ্ঞান দিয়ে, আমার কলম দিয়ে কাজ করব। কলমই আমার অস্ত্র। তবে এ অস্ত্র ব্যবহার করতে গিয়ে আমি এ যুদ্ধে পড়ে যাব, তেমনটা আমার চিন্তায় ছিল না। এখন সেটি ইতিহাস হয়ে গেছে। এরই মধ্যে পঞ্চাশ বছর চলে গেছে। এখন আমি দেখছি, কোন পথে দেশ এগিয়েছে- আমাকে বলতে হবে, অনেক উন্নতি হয়েছে। আমি যখন পরিকল্পনা কমিশন থেকে দেশ পুনর্গঠনে কাজ করছিলাম, তখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য ছিল। আমাদের সব বন্দর বন্ধ ছিল। সরকার চালানোর মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থাও ছিল না। এখন আমরা দেখছি এমন একটি দেশ, যেটি মধ্যম আয়ের দেশ, এমনকি একটি উন্নত দেশ হয়ে উঠছে। এটি নিশ্চিতভাবেই অসাধারণ অগ্রগতি। এটি সবাইকেই গ্রহণ করতে হবে। তবে আমি মনে করাতে চাই, আমাদের এখনও অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। কবি রবার্ট ফ্রস্ট থেকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির একটি উক্তি ছিল- 'উই হ্যাভ মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ/ উই হ্যাভ প্রমিসেস টু কিপ'। আমরা অসামান্য প্রতিম্রুতি রক্ষা করেছি। আমরা অসাধারণ উন্নয়নই অর্জন করেছি। তবে এটা সম্পূর্ণরূপে সবার মাঝে ভাগ করা আবশ্যক। সবার অংশীদারির মানে হলো- আমাদের কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে; এমন নীতি নির্ধারণ করতে হবে, যেখানে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত সবাই যুক্ত হবে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের কথা বলা যেতে পারে, যা প্রতিনিয়ত ভালো করছে। এ. কে. আজাদের মতো পথিকৃতরা এ শিল্পকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা অবশ্যই প্রশংসার পাত্র। তবে আমরা এখানে সফল হতে পারতাম না, যদি না লাখো গ্রামীণ নারী ঘর থেকে বের হয়ে আসতেন। তাঁদের শ্রম এখানে এ খাতকে সম্পদে পরিণত করেছে। এটি আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। একইভাবে আমাদের কৃষক, সেই ছোটো কৃষক, যাঁদের হাতে ৫ বিঘা বা ১০ বিঘা জমি আছে, তাঁরাই আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁরা আমাদের চাহিদা পূরণে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি খাদ্য উৎপাদন করছেন। আমাদের গ্রামের যে মানুষ অনেক কষ্ট করে, অনেক ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যান, তিনি এখন আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান অবদানকারী। এ অবদান ছাড়া ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা আয় সম্ভব হতো না। এ মানুষগুলোই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেন্দ্রে রয়েছেন। এখানে উদ্যোক্তা ও পেশাজীবীদের কথা উল্লেখ না করলেই নয়, যাঁদের আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদেরও এখানে বিশেষ অবদান রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এ অগ্রগতির কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের শুধু স্বীকৃতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, তাঁদের প্রণোদনা দেওয়াও জরুরি।
তখন আঞ্চলিক বৈষম্য ছিল। এখন সামাজিক বৈষম্য হয়ে গেছে। বাঙালি সমাজে এত বৈষম্য ছিল না। যখন আমাদের বেশ উন্নতি হয়ে গেল, তখন উন্নতির সঙ্গে বৈষম্যও বেড়ে গেছে সমাজের মধ্যে। এখন যাদের সুযোগ আছে, ক্ষমতার ওপর দখল আছে, তারা সে অনুযায়ী এগোচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে এটি অন্যায্য। একটা সমাজ এভাবে চলতে পারে না। সামাজিক ন্যায্যতার জন্য মেহনতি মানুষকে তাঁর অংশ দিতে হবে। শ্রম অনুযায়ী সেই ফসল তিনি পাবেন।
আমার মুখ বন্ধ ছিল না। আমার লেখা বন্ধ ছিল না। ষাট বছর ধরে আমি এ দর্শনের ওপর লিখেই যাচ্ছি। কেউ আমাকে বলতে পারবে না যে, আমার দৃষ্টি সুযোগের জন্য বদল হয়ে গেছে এখানে।
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এ পুরস্কারের জন্য আমি খুবই খুশি ও সম্মানিত বোধ করছি। এ খুশিকে সঙ্গী করেই আমি আগামী মাসে আমার ৮৮তম জন্মদিন উদযাপন করতে যাচ্ছি।
তখন আইয়ুব আমলে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি নিয়ে একটি লেখা লিখতে বলা হয় আমাকে। অর্থনৈতিক বৈষম্যকে কেন্দ্র করে আমি লিখেছি। বই প্রকাশের পর আমার লেখাটা সরকারের নজরে এলো। এরপর পুরো বই উঠিয়ে নেয় সরকার। এরপর আমার লেখা বাদ দিয়ে অন্য একজন আর্থনীতিবিদের লেখা যুক্ত করে রিপ্রিন্ট করা হয়। ওই সময়ই তো আমার কাছে পরিস্কার হয়ে যায় যে, সংগ্রাম তো একটা চলছেই। তখন সামরিক আইন চলছে। গণপরিসরে মানুষ এভাবে কথা বলছিল বা লিখছিল না। আমি লিখলাম। পাকিস্তান অবজারভার আমার লেখার ছাপ দিয়ে প্রকাশ করল। তখন আমি রাজনৈতিক নেতাদের নজরে আসি। সেই সঙ্গে সরকারের নজরেও আসি। যখন বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রকাশ করলেন, যেখানে আমার অর্থনৈতিক ফলাফল উঠে এসেছে; তখন আমার একটা প্রচারণা হলো, আমাকে অনেকেই চিনল।
স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার বিরল সুযোগ আমার হয়েছিল। সেখানে ভীষণভাবে তাঁদের অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। অসাধারণ মানবিক গুণের অধিকারী বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ছিল ক্যারিশম্যাটিক। সেইসঙ্গে ছিল তাজউদ্দীন আহমদের অনন্য বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্নেষণাত্মক দক্ষতা। এগুলো আমাকে শুধু নতুন দীক্ষাই দেয়নি; আমার কাজের ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে উঠেছে, তাকে সক্ষম করে তুলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাস আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থনৈতিক বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত দূত হিসেবে কাজ করেছি। সে সময় বাংলাদেশ সরকারের বার্তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে বহু মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের বিপরীতে আমাদের এ প্রচার অভিযান ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নুরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান ও আমাকে অধ্যাপক মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা কমিশন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। প্রথম বছরেই আমরা প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ শুরু করি। আমাদের থেকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তিধরদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করি, যাদের মুক্তিযুদ্ধে সমালোচনামূলক ভূমিকা ছিল। এ সবই অর্জিত হয়েছে যৌথ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।
পরবর্তীকালে আমি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এরপর ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ প্রতিষ্ঠার সময়েও আমি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এ সবই একেকটি যৌথ প্রচেষ্টা।
আমি বহু বছর ধরে দেখছি, এমন কোনো আয়োজন নেই যেখানে একটি গোটা প্রজন্মকে সংবর্ধনা জানানো হয়, যাঁরা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন, আর পরের ৫০ বছর ধরে দেশ গড়ার কাজ করে গেছেন। আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুরস্কার পাই। আমরা এর প্রশংসা করি। তবে আমি এ সম্মাননা আমার বিভিন্ন পর্যায়ের সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। আমি যা অর্জন করতে পেরেছি, সেটি তাঁদের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তবে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। আমার প্রয়াত স্ত্রী সালমা সোবহান; আমার বর্তমান সঙ্গী অধ্যাপক রওনক জাহান, যিনি সেই বিষয়গুলো, যেগুলো নিয়ে আমি ইতোমধ্যে কাজ করে ফেলেছি, তা নিয়ে আমার চেয়ে অনেক সুন্দরভাবে বলতে পারেন। জীবনের অনিশ্চয়তা, হতাশা; জীবনের প্রথম ভাগে আসা অস্থিরতা, যখন ভবিষ্যৎ থাকে অজানা- আপনজনদের কাছ থেকে পাওয়া শক্তি ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। আমি অনুভব করি, তাঁদের বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
আজ আপনারা আমাকে যে পর্যায়ে দেখছেন, যেখানে আমাকে কিছু সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে- আমার নিজের জীবনের লক্ষ্য তেমনটা ছিল না। আমরা বেড়ে উঠেছি এক সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারে। আমার সমকাতারের লোকজন বিলাসবহুল জীবন কাটিয়ে দেওয়াকেই বেছে নিতেন, যে সুযোগ তাঁদের রয়েছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। ১৯৫৯ সালে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে চলে আসি। আমার জমানো আবেগ, নিজের জীবন এবং যেসব সীমাবদ্ধ দক্ষতা আমি অর্জন করেছি, তা দেশের সংগ্রামে ব্যয় করার জন্য আমি প্রথমবারের মতো দেশটিকে নিজের ঘর বানাতে চলে আসি। অর্থনীতির ভাষায় প্লট লিনিয়ার গ্রাফের কথা বলা যেতে পারে, যেখানে আমার জীবন শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে কোনোভাবে আমার জীবনের শেষটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। তবে জীবনের প্রতিটি স্তরই ভীষণ জটিল ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি যুক্ত হওয়া। আমি যখন শিক্ষকতায় যুক্ত হলাম, বেশিরভাগ শিক্ষকই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিতর্ক করতেন, এ নিয়ে তাঁরা লিখতেন, যা কখনোই শাসকরা ভালোভাবে নিত না। সাধারণভাবে এটি মনে করিনি যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি প্লাটুন ঘরে ঢুকে পড়বে, যেমনটা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বিকেলে তারা করেছে। সেদিন তারা আমায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিযোগে আটক করে। সাধারণ শিক্ষকরা এমনটা যে হতে পারে সেটিও ভাবতেন না। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল, আমি ঘর থেকে বের হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি অংশ নিতে পেরেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মী তা করতে পারেননি। তাঁরা চরম মূল্য চুকিয়েছেন। যে ঘটনায় এখনও আমরা মর্মাহত হই, শোক পালন করি।
আমি যে এই পথে যাব, তা কখনোই আমার চিন্তায় ছিল না। চিন্তা ছিল- আমি আমার জ্ঞান দিয়ে, আমার কলম দিয়ে কাজ করব। কলমই আমার অস্ত্র। তবে এ অস্ত্র ব্যবহার করতে গিয়ে আমি এ যুদ্ধে পড়ে যাব, তেমনটা আমার চিন্তায় ছিল না। এখন সেটি ইতিহাস হয়ে গেছে। এরই মধ্যে পঞ্চাশ বছর চলে গেছে। এখন আমি দেখছি, কোন পথে দেশ এগিয়েছে- আমাকে বলতে হবে, অনেক উন্নতি হয়েছে। আমি যখন পরিকল্পনা কমিশন থেকে দেশ পুনর্গঠনে কাজ করছিলাম, তখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য ছিল। আমাদের সব বন্দর বন্ধ ছিল। সরকার চালানোর মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থাও ছিল না। এখন আমরা দেখছি এমন একটি দেশ, যেটি মধ্যম আয়ের দেশ, এমনকি একটি উন্নত দেশ হয়ে উঠছে। এটি নিশ্চিতভাবেই অসাধারণ অগ্রগতি। এটি সবাইকেই গ্রহণ করতে হবে। তবে আমি মনে করাতে চাই, আমাদের এখনও অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। কবি রবার্ট ফ্রস্ট থেকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির একটি উক্তি ছিল- 'উই হ্যাভ মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ/ উই হ্যাভ প্রমিসেস টু কিপ'। আমরা অসামান্য প্রতিম্রুতি রক্ষা করেছি। আমরা অসাধারণ উন্নয়নই অর্জন করেছি। তবে এটা সম্পূর্ণরূপে সবার মাঝে ভাগ করা আবশ্যক। সবার অংশীদারির মানে হলো- আমাদের কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে; এমন নীতি নির্ধারণ করতে হবে, যেখানে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত সবাই যুক্ত হবে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের কথা বলা যেতে পারে, যা প্রতিনিয়ত ভালো করছে। এ. কে. আজাদের মতো পথিকৃতরা এ শিল্পকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা অবশ্যই প্রশংসার পাত্র। তবে আমরা এখানে সফল হতে পারতাম না, যদি না লাখো গ্রামীণ নারী ঘর থেকে বের হয়ে আসতেন। তাঁদের শ্রম এখানে এ খাতকে সম্পদে পরিণত করেছে। এটি আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। একইভাবে আমাদের কৃষক, সেই ছোটো কৃষক, যাঁদের হাতে ৫ বিঘা বা ১০ বিঘা জমি আছে, তাঁরাই আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁরা আমাদের চাহিদা পূরণে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি খাদ্য উৎপাদন করছেন। আমাদের গ্রামের যে মানুষ অনেক কষ্ট করে, অনেক ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যান, তিনি এখন আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান অবদানকারী। এ অবদান ছাড়া ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা আয় সম্ভব হতো না। এ মানুষগুলোই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেন্দ্রে রয়েছেন। এখানে উদ্যোক্তা ও পেশাজীবীদের কথা উল্লেখ না করলেই নয়, যাঁদের আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদেরও এখানে বিশেষ অবদান রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এ অগ্রগতির কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের শুধু স্বীকৃতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, তাঁদের প্রণোদনা দেওয়াও জরুরি।
তখন আঞ্চলিক বৈষম্য ছিল। এখন সামাজিক বৈষম্য হয়ে গেছে। বাঙালি সমাজে এত বৈষম্য ছিল না। যখন আমাদের বেশ উন্নতি হয়ে গেল, তখন উন্নতির সঙ্গে বৈষম্যও বেড়ে গেছে সমাজের মধ্যে। এখন যাদের সুযোগ আছে, ক্ষমতার ওপর দখল আছে, তারা সে অনুযায়ী এগোচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে এটি অন্যায্য। একটা সমাজ এভাবে চলতে পারে না। সামাজিক ন্যায্যতার জন্য মেহনতি মানুষকে তাঁর অংশ দিতে হবে। শ্রম অনুযায়ী সেই ফসল তিনি পাবেন।
আমার মুখ বন্ধ ছিল না। আমার লেখা বন্ধ ছিল না। ষাট বছর ধরে আমি এ দর্শনের ওপর লিখেই যাচ্ছি। কেউ আমাকে বলতে পারবে না যে, আমার দৃষ্টি সুযোগের জন্য বদল হয়ে গেছে এখানে।
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এ পুরস্কারের জন্য আমি খুবই খুশি ও সম্মানিত বোধ করছি। এ খুশিকে সঙ্গী করেই আমি আগামী মাসে আমার ৮৮তম জন্মদিন উদযাপন করতে যাচ্ছি।
বিষয় : প্রচ্ছদ রেহমান সোবহান
মন্তব্য করুন