
মা-বাবার সঙ্গে রাতুল -সমকাল
'মা আমারে আদর করে, বাবায় মারে'। কথাটি বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ছেলেটি। তারপর নিজের মনেই বলে ফেলে, 'আমি আবার চইলা যাব'। মো. রাতুল ইসলামের শরীর দেখে মনে হবে শিশু। অথচ বয়স তার ১৪। বয়স বাড়লেও শরীর বাড়েনি, বুদ্ধি বাড়েনি। সারা শরীরে আগুনে ঝলসানো দাগ ও ঘা। গত বছর দেখা দেয় মৃগী রোগ। রোগের খিঁচুনির সময় রান্নার চুলার ওপর পড়লে আগুন লাগে গায়। দিনমজুর পিতা ছেলের উপযুক্ত চিকিৎসাও করাতে পারেননি। এ রকম একটি কিশোর কীভাবে কুমিল্লার অজপাড়াগাঁ থেকে চট্টগ্রামে গেল, বন্দরে পৌঁছাল এবং জাহাজের কনটেইনারে চড়ে বসতে পারল- সেসব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেক।
গত ১৩ বছরে জাহাজের কনটেইনারে লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার এমন ঘটনা ঘটেছে ৯ বার। এভাবে চেষ্টা চালানো ১০ জনের মধ্যে দু'জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিরা জীবিত ফিরতে পেরেছেন। এমন বিপজ্জনক যাত্রার সর্বশেষ যাত্রী হলো এই রাতুল। গত তিন মাসের মধ্যে এটি দ্বিতীয় ঘটনা। তবে কোনো কিশোর বয়সী প্রতিবন্ধী মানুষের এমন অভিজ্ঞতার কথা আর জানা যায় না। একে তো অতি গরিব পরিবার, তার ওপর প্রতিবন্ধী ও মৃগী রোগী হওয়ায় রাতুলের খোঁজ সবসময় রাখা সম্ভব হতো না পরিবারের পক্ষে। বাজারে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে খেত।
কিংবা হাঁটতে হাঁটতে চলে যেত ১০ কিলোমিটার দূরের নানাবাড়িতে। মাঝে মাঝে কয়েকদিনের জন্য হারিয়ে গেলেও ফিরে আসত।
কিন্তু গত বছরের ১৩ নভেম্বর বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি অন্যরকম। গত ২০
জানুয়ারির আগে রাতুলের পরিবার জানতেই পারেনি ছেলে কোথায় আছে। গণমাধ্যমে
প্রচারিত ছবি ও ভিডিও থেকে তাঁরা জানতে পারে রাতুলের খবর। রাতুলের বাবা
বলেন, টিভিতে ছেলের ছবি থেকে তাকে চিনতে কষ্ট হয়নি। গত ১২ জানুয়ারি
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া 'এমভি ইন্টেগ্রা' জাহাজের একটি খালি
কনটেইনার মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ১৬ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার কেলাং
বন্দরে জাহাজের একটি খালি কনটেইনারের ভেতর থেকে মানুষের কণ্ঠ শুনতে পান
নাবিকরা। এর পরই কেলাং বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়। ১৭ জানুয়ারি
বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় জাহাজটি জেটিতে এনে কনটেইনার খুলে ওই কিশোরকে
উদ্ধার করা হয়। অথচ এরই মধ্যে চলে গেছে পাঁচ দিন। বন্ধ কনটেইনারে রাতুলের
বেঁচে থাকাও তার বিপজ্জনক যাত্রার মতোই বিস্ময়কর।
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার ঝলম দক্ষিণ ইউনিয়নের সাতপুকুরিয়া গ্রাম। ওই গ্রামে বিলের ভেতর পাশাপাশি দুটি ঘর। একটি ঘরে টিনের দেয়াল থাকলেও অন্যটি ত্রিপল ও পলিথিনে ঘেরা। এটাই রাতুলদের ঘর। এখানেই বৃহস্পতিবার দুপুরে রাতুল, তার বাবা-মা ও স্ব্বজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। রাতুলের বাবা ফারুক মিয়া দিনমজুরি করে টানাটানির সংসার চালান। পাশের ঘরটি রাতুলের চাচার। গৃহহীন দুটি পরিবারের মাথা গোঁজার এই সামান্য ঠাঁইটি করা হয়েছে এলাকাবাসীর চাঁদায়। প্রতিবেশী আলী আহাম্মদ বলেন, গ্রামের লোকজন টাকা তুলে ৫ শতাংশ জমি কিনে দেন রাতুলের বাবা ও তার চাচা আজগর আলীকে। উভয়ই দিনমজুর। এক বেলা খেলে তো আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হয় পরিবারটিকে।
রাতুলের বাবা জানান, ছেলের কাছে প্রশ্ন করে ভাঙা ভাঙা উত্তর পাচ্ছেন। ছেলের হয়ে তিনিই বললেন, রাতুলকে চট্টগ্রাম বন্দরে ও জাহাজে ঢুকতে কেউ মানা করেনি। কীভাবে চট্টগ্রামে গেল- এ প্রশ্নের জবাবে রাতুল জানায়, একটা গাড়িতে উঠে কোথায় যাই বুঝি নাই। কনটেইনারে উঠতে কেউ বাধা দেয়নি- এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জানায়, কেউ কিছু বলেনি। ভেতরে গরম ছিল কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সে জানায় গরম ছিল না। রাতুল জানায়, কিছু লোক তাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়, পরে তাকে ভাত, চা ও বিস্কুট খেতে দেন। কিন্তু কনটেইনারের ভেতর ৫ দিন কীভাবে ক্ষুধা সহ্য করেছে সে, নাকি তার সঙ্গে কোনো খাবার ছিল; তা জানাতে পারেনি ছেলেটি। বলতে পেরেছে, খেলতে খেলতে কনটেইনারের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। জানত না কোথায় আছে বা কোথায় যাচ্ছে। পরে কেউ বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়ায় আটকে যায় সে।
রাতুলের খবরটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে প্রতিক্রিয়া জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, 'কিশোর রাতুলকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।' সরকারি ব্যবস্থাপনায় মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৯টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায় রাতুল। রাতুলের সঙ্গে ছিলেন কুয়ালালামপুর বাংলাদেশ হাইকমিশনের কল্যাণ সহকারী মোকছেদ আলী। তিনি ওই দিন রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে রাতুলকে হস্তান্তর করেন পরিবারের কাছে। বিমানবন্দরে রাতুলের বাবা ছাড়াও মা রোকেয়া বেগম, চাচা আজগর আলী, মামা বাবুল মিয়া ছিলেন। বিমানবন্দরের কিছু প্রক্রিয়া শেষে রাতুল তার মামার বাসায় চলে যায়। সেখান থেকে বুধবার রাতে বাড়ি ফেরে।
রাতুলের চাচা আজগর আলী বলেন, 'বন্দরে এত নিরাপত্তার মধ্যে সে কীভাবে ভেতরে গেল, কীভাবে কনটেইনারের ভেতরে ঢুকে মালয়েশিয়ায় গেল- এসব প্রশ্নের উত্তর তো আমরা দিতে পারব না। এর উত্তর বন্দরের লোকজনকেই দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, গ্রামের লোকজন থেকে আমরা ৪ হাজার টাকা হাওলাত করে বিমানবন্দরে যাই, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকার কোনো আর্থিক সহায়তা করেনি।' রাতুলের বাবা বলেন, ঢাকায় আসা-যাওয়ার ভাড়াও অন্যের কাছ থেকে নিতে হয়েছে। এয়ারপোর্টে রাতুলের জন্য ওরা চারটি গেঞ্জি, পাঁচটি হাফ ও লং প্যান্ট, এক প্যাকেট করে দুধ, চিনি, বিস্কুট, চকলেট ও চা দিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা না পেলেও বাংলাদেশ ও মালশেয়াশিয়া সরকারকে ধন্যবাদ অতি কম সময়ে ছেলেকে আমাদের বুকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল আলম কমল সমকালকে বলেন, রাতুলের পরিবারটি অত্যন্ত দরিদ্র। তাদের থাকার ঘরটিও ভালো নয়। রাতুল ও তার বাবাকে আমার কার্যালয়ে আনা হয়েছিল। তাদের কষ্টের বিষয়টি জানতে পেরে কিছু টিন বরাদ্দ দিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির তাদের কিছু টিন দিতে পারব, যা দিয়ে এ দরিদ্র পরিবারের থাকার ঘরটি ভালোভাবে তৈরি করে নিতে পারবে।
চলে আসার সময় দেখা যায়, রাতুলের ছোট দুই ভাই রিফাত (১০) ও আশিক (৮) বড়
ভাইকে ঘিরে আছে। জিজ্ঞেস করলে রিফাত বলে, 'ভাইকে হারায়া অনেক কাঁদছিলাম,
অহন আমরা খুশি।'
মন্তব্য করুন