দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও গ্যাস-বিদ্যুতের অতিরিক্ত দামে প্রতিদিন দুই বেলা মুখের গ্রাস জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এমন সময় নগরে এক টুুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজা অলীক স্বপ্ন। নাগরিক জীবনে মাথার ওপর পাকা ছাদের স্বপ্ন দেখা এখন 'ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে চাঁদ ধরা'রই নামান্তর। তবুও সবাই চান নগরে একটি স্থায়ী ঠিকানা। তা নিয়ে মধ্যবিত্তের হাহাকারের অন্ত নেই। একদিকে জমির মূল্য বাড়ছে, অন্যদিকে হুহু করে বাড়ছে নির্মাণসামগ্রীর দাম। তুলে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদের হারের 'সীমা'ও। তাই সাধ্য ও সাধ্যের মধ্যে ফ্ল্যাট তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। তবুও একটি ঠিকানা জোগাড়ে থাকে মানুষের নিরন্তর চেষ্টা। তারই অংশ হিসেবে ঠিকানার খোঁজে থাকা মানুষ উদ্ভাবন করে নিত্যনতুন পদ্ধতি। তারই একটি 'যৌথ উদ্যোগ'।

এই পদ্ধতিতে কিছু মানুষ জোট বেঁধে একটি সমিতি দাঁড় করান। তাঁরা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমান। এরপর নিজেরা পছন্দ করে কিনে নেন এক টুকরো জায়গা। সেই জায়গায় গড়ে তোলেন স্বপ্নের আবাস। ভবন নির্মাণের টাকা সমান ভাগে খরচ করেন। পরে ভাগাভাগি করে নেন ফ্ল্যাট। এভাবে নগরের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক ভবন তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। এমন জোট বেঁধে ভবন তৈরিতে শুধু ব্যবসায়ী কিংবা ব্যাংকাররা নন; সরকারি কর্মকর্তারাও রয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এতে ব্যয় যেমন কম, তেমনি প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। আবার সামর্থ্যের মধ্যে ধীরে ধীরে নির্মাণকাজ করা যায়। ঋণের চাপও থাকে না।

মোহাম্মদ ওয়াজেদ। মাঝারি পুঁজির ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন ধরে নগরে একটি ঠিকানা তৈরির জন্য ছিল তার নিরন্তর চেষ্টা। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে না হওয়ায় তিনি এক ঠুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত করতে পারেননি। এখন সমমনা কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছেন সমিতি। সমিতির কোনো নামধাম নেই।

তিনি আরও বলেন, 'নগরে মোটামুটি মানের একটি ফ্ল্যাটের দাম এখন কোটি টাকার কাছাকাছি। আমরা যাঁরা নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তাঁদের জন্য এ ফ্ল্যাট কেনা কোনোভাবে সম্ভব নয়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জোগাড় করা টাকায় ফ্ল্যাট কিনলেও তা কবে বুঝে পাব, তারও নিশ্চয়তা থাকে না। অনেক সময় প্রতারিতও হন লোকজন। তাই আমরা ৩০ জন মিলে একটি সমিতি করেছি। প্রথমে দুই লাখ টাকা করে দিয়েছি। এরপর প্রতিজন মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে জমাচ্ছি। এখন আমরা নগরে একটি জায়গা খুঁজছি, যেখানে আস্তে আস্তে আমাদের স্বপ্নের বসতি গড়ে তুলব। এভাবে করলে ব্যাংক ঋণের চাপ যেমন নেই, তেমনি প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। সামর্থ্যের মধ্যে পছন্দ অনুযায়ী নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে নির্মাণকাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।'

এমন আরেকটি সমিতি আছে শিমুল বড়ূয়াদের। তাঁদের সমিতিতে লোক রয়েছেন ৪২ জন। প্রতিবছর দুইবার একসঙ্গে দেন ২০ হাজার টাকা। প্রতি মাসে দেন দুই হাজার টাকা করে। এভাবে পাঁচ বছর ধরে তাঁরা টাকা জমাচ্ছেন। শিমুল বড়ূয়া জানান, তাঁরা নগরের শমসেরপাড়া আর আতুরার ডিপো এলাকায় দুটি জায়গা পছন্দ করেছেন। এর মধ্যে যে কোনো একটি কিনে তাঁরা ভবন নির্মাণ করবেন। যেখানে লটারির মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের মধ্যে ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে নেবেন। যাঁর ভাগে নির্মাণ-ব্যয় যত পড়ে, তিনি ততটা বহন করবেন।

শুধু বেসরকারি মানুষই নন, সরকারি কর্মকর্তারাও হাঁটছেন এই পথে। সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৫ কর্মকর্তা মিলে একটি সমিতি গড়ে তুলেছেন। তাঁরা ব্যাংকে যৌথ হিসাব খুলে শুরুতে প্রতিজন ১২ হাজার টাকা করে জমা দিয়েছেন। এরপর প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে জমাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের একজন মিজানুর রহমান। তিনি নগরে একটি কলেজের শিক্ষক। তিনি বলেন, 'সরকার যে ঋণ দিচ্ছে, তাতে জায়গা কিনে ভবন করা কোনোভাবে সম্ভব নয়। আবার ঋণ নিলে তা শোধ করার চাপ থাকে। সংসার খরচ সামাল দিয়ে তা শোধ করাও দুঃসাধ্য। তাই যৌথ উদ্যোগে আস্তে আস্তে নিজেদের একটি ঠিকানা তৈরির চেষ্টা করছি। সবাই মিলে একটি জায়গা কিনতে পারলে সেখানে ভবন নির্মাণে ব্যয় যেমন কম হবে, তেমনি একার ওপর চাপও কম পড়বে। এভাবে আমাদের পরিচিত অনেকে করেছেন। আমরাও পারব বলে আশা করছি।'

ফ্ল্যাটের দাম মধ্যবিত্তের নাগালে বাইরে চলে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী। তবে সাধারণ মানুষের এই যৌথ উদ্যোগকে কর ফাঁকির বড় ফাঁদ বলে দাবি করেছেন রিহ্যাবের চট্টগ্রামের রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী। তিনি বলেন, 'এভাবে গ্রুপভিত্তিক ফ্ল্যাট ডেভেলপ চলতে থাকলে আমাদের ওপর চরম একটা আঘাত আসবে। কোনো নিবন্ধন ছাড়া ফ্ল্যাট করছেন তাঁরা। এটা এখনই শক্ত হাতে সমাধান করতে হবে। নয়তো বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। আবাসন খাত ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়বে।'

আবারও সংকটে আবাসন খাত :আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা জানান, ২০১২ সাল থেকে আবাসন ব্যবসার মন্দা শুরু হয়। ২০১৪ সালের হিসাবে, চট্টগ্রামে রিহ্যাবের সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ১০ হাজার ফ্ল্যাটের মধ্যে অবিক্রীত পড়ে ছিল প্রায় পাঁচ হাজার। সে সময় অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল এ বাজার। বিশেষ করে মন্দা শুরু হওয়ার পর মৌসুমি ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের প্লট বা ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিয়ে সটকে পড়েন। মন্দার কারণে বেচাকেনা কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ আটকে যায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদেরও। তখন থেকে আবাসন খাতে নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমে আসে। চলমান প্রকল্পগুলোর গ্রাহকদের সাড়া কম থাকায় নির্মাণকাজ শেষ করার সময় পিছিয়ে দেন উদ্যোক্তারা। এসবের ফলে গ্রাহকদের আস্থায় ভাটা পড়ে। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও ছিল এ অবস্থা। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যবসায়ীরা কয়েক বছরে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে ঝুঁকে পড়েন। তবে মন্দার ধাক্কায় যেসব প্রতিষ্ঠান বাজারে টিকে ছিল, তারাই এখন গ্রাহকদের আস্থা ধরে রেখেছে। কয়েক বছরের মন্দার পর ২০১৫ সালের জুন মাস থেকে স্থবিরতা কাটতে শুরু করে আবাসন খাতে। ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে কয়েক হাজার অবিক্রীত ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। ফ্ল্যাটের দামও যৌক্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছিল। কিন্তু করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আবারও সংকটে পড়েছে আবাসন খাত। একদিকে দিন দিন বাড়ছে নির্মাণসামগ্রীর দাম। রড, ইট, বালু, পাথর, সিমেন্ট, থাই গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম পণ্য, এসএস পাইপ, ইনডোর ফিটিংসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দাম ১০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে নির্মাণসামগ্রী আমদানি সংকটও দেখা দিয়েছে। ব্যাংক ঋণে সুদ হারের সীমা তুলে দেওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও মনে করছেন তাঁরা। বৈশ্বিক মন্দার এ ধাক্কা সামাল দিতে না পেরে ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে সটকে পড়েছে। কেউ কেউ ঋণ খেলাপি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে রিহ্যাব চট্টগ্রাম অঞ্চলের কো-চেয়ারম্যান মাহবুব সোবহান জালাল তানভীর বলেন, 'মহামারি করোনার ধাক্কা কাটিয়ে যখন ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলেন, তখনই অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করে নির্মাণসামগ্রীর দাম। এতে আবারও বেকায়দায় পড়েন আবাসন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় শুল্ক্ক কমিয়ে রড-সিমেন্টের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি আমরা। নয়তো সামনে এই খাতকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।'