ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদের দুই নেতাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মাদক ও নাশকতার মামলা করেছে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর মহেশ্বরপাশা প্রধান সড়ক থেকে দলটির খুলনা জেলা সদস্য সচিব হামিদুর রহমান রাজিব এবং সোনাডাঙ্গা আল আমিন মহল্লা থেকে বাগেরহাট জেলা সদস্য সচিব নুরুল ইসলামকে আটক করা হয়।

পরে হামিদুর রহমান রাজিবকে এক কেজি গাঁজাসহ মাদক মামলায় এবং নুরুল ইসলামকে জামায়াত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা পুরোনো একটি নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

তবে দুই নেতার পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহেশ্বরপাশা বাড়ি থেকেই হামিদুর রহমান রাজিবকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই রাজিবদের বাড়ি ঘিরে রাখে গোয়েন্দা পুলিশ। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে ওই এলাকার আনিসের মোড়ে নিয়ে এক কেজি 'গাঁজা উদ্ধার' দেখিয়ে রাতেই দৌলতপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়।

এলাকাবাসী জানান, রাজিব ঢাকায় থাকে, ভিপি নুরের দল করে। গত সপ্তাহে অসুস্থ মাকে দেখতে সে খুলনায় আসে। অতীতে কখনও রাজিবের বিরুদ্ধে মাদক বিক্রি বা সেবনের কোনো অভিযোগ তাঁরা পাননি।

অন্যদিকে বাগেরহাট জেলা সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম তার ছেলেকে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। সেখানে তাকে আটক করে সোনাডাঙ্গা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর খুলনা সদর থানায় জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একটি নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে দুই নেতাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে খুলনা জেলা গণঅধিকার পরিষদ। সেখানেও তাদের বাধা দেয় পুলিশ।

দলটির নেতারা জানান, গতকাল শনিবার খুলনায় গণঅধিকার পরিষদের প্রতিনিধি সভা হওয়ার কথা ছিল। সেখানে দলের প্রধান ড. রেজা কিবরিয়া ও সদস্য সচিব ভিপি নুরের উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু সভাটি স্থগিত করা হয়েছে।

যে মামলায় রাজিব গ্রেপ্তার: এজাহারে বলা হয়, "২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে, মহেশ্বরপাড়া মেইন রোডের আনিসের মোড়ের 'অস্থায়ী নিবাস' নামের বাড়ির সামনে পাকা রাস্তায় একজন লোক মাদকদ্রব্য গাঁজা বিক্রির উদ্দেশে অবস্থান করছে। রাত ৯টায় সেখানে উপস্থিত হলে পালানোর চেষ্টাকালে কাজী হামিদুর রহমান রাজিবকে আটক করা হয়। এ সময় তার ডান হাতে থাকা একটি প্লাস্টিকের বাজারের ব্যাগের মধ্যে পলিথিনে রক্ষিত ১ কেজি গাঁজা, যার মূল্য আনুমানিক ৬০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।" এই মামলার বাদী নগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই নিয়াজ মোরশেদ।

প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসী যা বললেন: নগরীর মহেশ্বরপাশা এলাকার দক্ষিণ বণিকপাড়া বায়তুল হুদা জামে মসজিদের (যশোর মহল্লা) বিপরীত পাশেই রাজিবদের বাড়ি। শনিবার দুপুরে রাজিবদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, গাছগাছালিতে ভরা বিশাল বাড়িতে শুধু রাজিবের মা খালেদা বেগম থাকেন। তিনি অসুস্থ।

স্থানীয়রা জানান, রাজিবের বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। তিন ভাইয়ের সবাই ঢাকায় ব্যবসা করেন। রাজিবও ঢাকায় ভাইদের ব্যবসা দেখাশোনা করেন। অসুস্থ মাকে দেখতে ৪-৫ দিন আগে খুলনায় এসেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই পুলিশ তাদের বাড়িতে অবস্থান নেয়। সন্ধ্যা থেকেই তল্লাশি চালায়। রাত ৮টার দিকে রাজিব এলে তাকে মারধর করে আনিসের মোড়ের দিকে নিয়ে যায়। পরে জানা যায়, গাঁজাসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

রাজিবদের বাড়ির ঠিক বিপরীত পাশেই বায়তুল হুদা জামে মসজিদ। মসজিদের মুয়াজ্জিন গোলাম রহমান বলেন, গত ১৪ বছরে রাজিব ভাইয়ের মধ্যে কোনো খারাপ কিছু দেখিনি। ফেসবুকে বিভিন্ন সময় তিনি ভিপি নুরের হয়ে পোস্ট দিতেন। বাড়িতে এলে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ওই দলে যোগ দিয়েছেন। রাজিব গাঁজা বিক্রি করে এটা শুধু আমি কেন- কেউ বিশ্বাস করবে না।

রাজিবদের বাড়ি থেকে বের হতেই আনিসের মোড়। বেশ কিছু দোকান রয়েছে সেখানে। পুলিশের দায়ের করা মামলার এজাহারে মোড়ের চা দোকানি মিজানুর রহমান ও শ্রমিক রাজু গাজীকে সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে। মোড়েই পাওয়া গেল তাদের।

এর মধ্যে চা দোকানি মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, 'পুলিশ ওকে ধরে এনে বলেছে ওর কাছ থেকে গাঁজা উদ্ধার হয়েছে আপনারা দেখেন। গাঁজা কোথা থেকে উদ্ধার হয়েছে আমি দেখিনি।' তিনি বলেন, 'অনেক আগে থেকেই ওকে চিনি। কিন্তু মাদক খাওয়া বা বেচা এমন কোনো কাজে কখনও দেখিনি।' একই কথা বলেন মামলার আরেক সাক্ষী রাজু।

বাগেরহাট সদস্য সচিবের বিরুদ্ধে নাশকতা মামলা: মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে পাঠানো খুলনা সদর থানা পুলিশের প্রতিবেদনে বাগেরহাট জেলা সদস্য সচিব নুরুল ইসলামকে নাশকতা মামলার আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৩ ডিসেম্বর জামায়াতের নেতাকর্মীরা তাদের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে নাশকতা করার উদ্দেশ্যে নগরীর টুটপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে সমবেত হয়। সেখান থেকে দুটি ককটেলসহ বিভিন্ন বস্তু উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ১৩ ডিসেম্বর খুলনা সদর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। এই মামলায় ইতোপূর্বে গ্রেপ্তার আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে নুরুল ইসলামের নাম প্রকাশ করে। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ১০ মিনিটে সোনাডাঙ্গা থানার আল আমিন মহল্লা থেকে আটক করা হয়েছে।

নুরুল ইসলামের স্ত্রী নাজনীন আকতার সমকালকে বলেন, 'মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের খুলনা শাখাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বৃহস্পতিবার রাতে মাদ্রাসা থেকে ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফেরার সময় একদল পুলিশও বাসায় আসে। পরে পুলিশ তাকে নিয়ে চলে যায়। পরে আমরা থানায় গেলে আমাদের জানায়, ভিপি নুরকে চেনেন? ওর দল করে কেন?

সংবাদ সম্মেলন ও পুলিশের বাধা: দুই নেতাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে শনিবার দুপুরে নগরীর নবপল্লী কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে গণঅধিকার পরিষদের খুলনা জেলা শাখা। একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত হয় সোনাডাঙ্গা থানা পুলিশ। তারা জানতে চায়, অনুমতি ছাড়া সংবাদ সম্মেলন করছেন কেন, এটা সংবাদ সম্মেলনের জায়গা নয়, বক্তব্য থাকলে থানায় আসুন বলে নানা রকম ভীতি প্রদর্শন করে।

লিখিত বক্তব্যে দলের খুলনা জেলা আহ্বায়ক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, হামিদুর রহমান রাজিবকে আটকের সময় ব্যাপক মারধর করা হয়। তিনি অভিযোগ করেন, গত ৩ দিন ধরে আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়েও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

পুলিশের বক্তব্য: হামিদুর রহমান রাজিবের মামলার বাদী ও নগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই নিয়াজ মোরশেদ বর্তমানে সাতক্ষীরা অবস্থান করছেন। মোবাইল ফোনে সমকালের কাছে তিনি দাবি করেন, এক কেজি গাঁজাসহ হাতেনাতে রাজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর আরও কিছু আছে কিনা খুঁজতে ওদের বাড়ি তল্লাশি চালানো হয়। এলাকাবাসীর বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই মোড়ে অনেক মানুষের সামনেই তাকে আটক করা হয়েছে। রাজিব নিজেও গাঁজা বিক্রির কথা স্বীকার করেছে।

খুলনা সদর থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জামাল উদ্দিন বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে কোন দল করে এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়।