বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একদিকে মানুষের রক্ত ঝরেছে, অন্যদিকে আলোড়ন চলেছে বিশ্বজুড়ে। সেই জটিল ও কঠিন সময়ের আঁচ দিতে সমকাল ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা নথি এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে প্রকাশিত বই নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। আজ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৭১-এর ৪ মার্চের মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোভাব ও পদক্ষেপ নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মূল্যায়নের বাছাই অংশ। অনুবাদ ও গ্রন্থনা : ফারুক ওয়াসিফ


মার্চের ৪ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে একটা ফোন আসে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র বিভাগ থেকে ইসলামাবাদের আমেরিকান দূতাবাসে একটা টেলিগ্রাম পাঠানো হয়। সেখানে উঠে আসে জনৈক হারুন রশীদের কথা। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ বার্তা নিয়ে ঢাকা থেকে তখনই ওয়াশিংটনে পৌঁছান। হারুন রশীদ সে সময়ে ছিলেন আন্তর্জাতিক পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তা। এটি বিশ্বব্যাংকেরই একটি ঋণদানকারী শাখা। হারুন রশীদের বার্তা এবং তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ভেতরের আলোচনাই ৫ মার্চে পাঠানো তারবার্তার বিষয়। নিচে তার নির্বাচিত অংশ তুলে দেওয়া হলো :

সূত্র বলছে, হারুন রশীদ দুই থেকে তিন দিন আগে ঢাকা থেকে ফিরেছেন। সেখানে ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর ফিরে আসার ঠিক আগে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। রশীদ জানিয়েছেন, মুজিব মার্চের ৭ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরিকল্পনা নিয়েছেন এবং তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া আশঙ্কা করছেন।

মুজিব রশীদকে অনুরোধ করেছেন– ১. পাকিস্তানি বাহিনী যদি বিচ্ছিন্নতা ঠেকাতে সামরিক অভিযানে নামে, তাহলে বাঙালিদের স্বাধীনতার পক্ষে জাতিসংঘে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হতে; ২. যুক্তরাষ্ট্র সরকারের (ইউএসজি) বার্তা পৌঁছানো যে যদি স্বাধীনতা ঘোষিত হয় তবে মুজিব আশা করেন, যুক্তরাষ্ট্র দ্রুতই স্বীকৃতি দেবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা রদ করাসহ পাকিস্তান সরকারের ওপর প্রভাব খাটিয়ে আগেভাগেই দমনমূলক সামরিক পদক্ষেপ ঠেকিয়ে দেওয়া অথবা তা থামানোয় ভূমিকা নিতে। রশীদ বলেছেন, মুজিব ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেলের (আর্চার ব্লাড) কাছেও একই ধরনের কথা বলেছেন।

রশীদ বলেছেন, মুজিবের ৭ তারিখের ঘোষণা খোলামেলাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা হবে না, বরং পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নের আহ্বান হবে। পশ্চিম পাকিস্তানও সেটাই করতে পারে এবং উভয়ে মিলে কোনো ধরনের কনফেডারেশনের আদলে একসঙ্গে থাকার উপায় খোঁজা হবে।

রশীদ (ওয়াশিংটনের) পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাঁরা সকলে মুজিবের পরিকল্পনায় মদদ দিতে প্রস্তুত। তবে আপাতত তাঁদের কেউ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই দায়িত্ব তাঁরা রশীদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা একমত হয়েছেন যে, স্বাধীনতা ঘোষিত হলে দূতাবাসের বর্তমান মিনিস্টার/ডিসিএম ঊর্ধ্বতন বাঙালি কর্মকর্তা এনায়েত করিম দূতাবাসের দায়িত্ব নেবেন এবং সাততাড়াতাড়ি, সম্ভব হলে ৭ মার্চেই মার্কিন দপ্তরে নতুন সরকারের পক্ষে কথা বলবেন। বিশ্বের অন্যান্য রাজধানীতেও একই কাজ করা হবে। রশীদ পাকিস্তান রাষ্ট্রদূত হিলালির বরাতে জানান, মার্চের ৪ তারিখেই হিলালি মনে করছেন, পাকিস্তান আর এক থাকবে না এবং বাঙালি কর্মকর্তারা পরের সপ্তাহেই যেন নিজস্ব মিশন চালু করার কাজ শুরু করেন।

রশীদের আশঙ্কা, সামরিক বাহিনী হয়তো ৭ মার্চের আগেই মুজিবকে দমনের চেষ্টা করবে। আদতে তিনি মনে করেন, পূর্ব পাকিস্তানে সেনা মোতায়েন করার মাধ্যমে সামরিক অভিযান শুরু হয়ে গেছে। তারা বিমানক্ষেত্র পাহারা দিচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানি পুলিশদের নিরস্ত্র করছে এবং সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাচ্ছে।

রশীদ পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, মুজিবের কাছ থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আগাম বার্তা দেওয়ার নির্দেশ পেয়েছেন।

হারুন রশীদ একজন বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তা, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কৃষি দপ্তরে যুগ্ম সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। এক বছর আগে তিনি আইবিআরডিতে যোগ দিয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্র ওয়াকিবহাল যে, মুজিবের যে কোনো সরকারে রশীদ বড় পদ পেতে যাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসলামাবাদে পাঠানো ওপরের তারবার্তার পাশাপাশি আরেকটা নথি প্রকাশ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। এটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তা হ্যারল্ড স্যান্ডার্স ও স্যামুয়েল হসকিনসন কর্তৃক প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বরাবর পাঠানো একটা চিঠি। ‘পাকিস্তানের পরিস্থিতি’ শিরোনামে এই চিঠিতে বলা হয়, গত রাতের প্রতিবেদন থেকে বোঝা যাচ্ছে যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে যাচ্ছে‌। নতুন ঘটনাগুলো হলো এই :
দৃশ্যত মনে হচ্ছে, বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে মার্চের ১০ তারিখে কনফারেন্স করার যে পরিকল্পনা ইয়াহিয়া খান করেছিলেন, তা নাকচ করে দিয়ে মুজিবুর রহমান কার্যত দুই পাকিস্তানের মধ্যে সমন্বয়ের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

মুজিব কয়েকজন বিদেশি সংবাদদাতার কাছে ‘অফ দ্য রেকর্ড’ বলেছেন, আগামী রোববার (৭ মার্চ) তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সমতুল্য ঘোষণা দেবেন। তাহলেও তিনি বলে যাচ্ছেন যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উচিত, যার যার সংবিধান প্রণয়ন করা এবং তারপর আলোচনায় বসা যে কী আদলে উভয় অংশের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা যায়। [এর মাধ্যমে কনফেডারেল সম্পর্কের জন্য দরজা খোলা হলো এবং এ কারণেই আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া উচিত নয়।]

সূত্র: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মহাফেজখানার ওয়েবসাইট এবং ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস ১৯৫৩-১৯৭৩, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যান্ড স্ট্রাগল ফর ইনডিপেনডেন্স, হাক্কানি পাবলিশার্স, ঢাকা, মার্চ ২০১৩ সংস্করণ।