জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) প্রায় ৭০০ একরের সবুজ ক্যাম্পাসে আছে ছোট-বড় ২৬টি জলাশয়। যেখানে প্রতিবছর শীতে আশ্রয় নেয় কয়েক হাজার পরিযায়ী পাখি। এ ছাড়া সবুজে পরিপূর্ণ ক্যাম্পাস এলাকায় রয়েছে ১৪৫ গোত্রের ৫৭৪টি পরিবারের ৯১৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। বন্যপ্রাণীর মধ্যে দেখা যায় ১১ প্রজাতির উভচর, ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও ২০৫ প্রজাতির পাখি। ২২ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীরও আবাসভূমি এই ক্যাম্পাস। অথচ নানামুখী কারণে আজ ধ্বংসের পথে ক্যাম্পাসে সবুজের আচ্ছাদন। অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে এখানে বাড়ছে বহুতল ভবন। এতে নষ্ট হচ্ছে পাখির ফ্লাইংজোন। জঙ্গল পরিষ্কারের নামে আগুন দেওয়া হচ্ছে ঝোপঝাড়ে। ফলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। এই সময় ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার (ডব্লিউআরসি)।

বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল অংশের দক্ষিণ দিকে একটি সংরক্ষিত এলাকায় অবস্থিত ডব্লিউআরসি। সেখানে সবাই প্রবেশ করতে পারে না। ফলে প্রাণীরা জায়গাটিতে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারে। মূলত বিপন্নপ্রায় প্রাণীর ওপর গবেষণা করে পুনরায় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করতে ২০০৪ সালে পাঁচ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় ডব্লিউআরসি। যদিও এর পটভূমি তৈরি হয়েছিল বহু আগে। ১৯৯০ সালে জাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বন্যপ্রাণী গবেষণা সংক্রান্ত শাখায় বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। দীর্ঘদিন এই শাখার শিক্ষার্থীরা দেশের বন্যপ্রাণীর সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক, আচরণ ও সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণী নিয়ে থিসিস এবং গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করেছে।

ডব্লিউআরসির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ বলেন, স্থানীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বন্যপ্রাণী গবেষণা শাখা নিবিড়ভাবে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠার এক যুগ পর সরকার এ ধারণাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নেয় এবং বন বিভাগও বিভিন্ন জায়গায় ডব্লিউআরসি তৈরি করে। এখানে সরকার অর্থায়ন করে না। কিন্তু বন্যপ্রাণী গবেষণা কেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকদের অর্থায়নে এটি পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া বিভাগের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা গবেষণা কেন্দ্র ও ডব্লিউআরসি  পরিচালনায় সহায়তা করছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একজন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে।

প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ক্যাম্পাসে আগে যেসব প্রাণী পাওয়া যেত তার মধ্যে খরগোশ ছাড়া সব ডব্লিউআরসিতে পাওয়া যায়। আমরা নিয়মিত অ্যানিমেল ট্র্যাকিং করি। ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে প্রাণী শনাক্ত করা হয়। এ ছাড়া প্রতিবছর করা হয় বার্ড সেন্সাস। বর্তমানে ডব্লিউআরসি এলাকায় আছে– পটকা ব্যাঙ, সোনাব্যাঙ, হলুদ গুইসাপ, নাখতা পাখি, হুতুমপেঁচা, খেঁকশিয়াল, গন্ধগোকুল, বনবিড়াল, মেছোবিড়াল, উইপোকার ঢিঁবি, বিষাক্ত সাপ নাজানাজা (কোবরা) ইত্যাদি। এখানে সবসময় একশ প্রজাতির পাখি দেখা গেলেও শীতে সংখ্যা বাড়ে। বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় ভোঁদড় উদ্ধারের পর রক্ষণাবেক্ষণ করে এর বাচ্চা উৎপাদনের কাজ চলছে। মোট কথা, পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্যপ্রাণীদের প্রজননের মাধ্যমে প্রায় বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ডব্লিউআরসি। ইতোমধ্যে এর মাধ্যমে বন্যপ্রাণী রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে মডেল হয়েছে জাবি।

অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, আমরা বন বিভাগের সঙ্গে মিলে পাখি ও প্রজাপতি মেলার আয়োজন করি। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ও কিয়েটো ইউনিভার্সিটির সঙ্গেও জাবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ডব্লিউআরসি শাখার মধ্যে বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিনিময়ের চুক্তি হয়েছে। যার মাধ্যমে এখানে এসে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকরা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে ফিল্ড ট্রেনিং দিয়েছেন। এই প্রশিক্ষণে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫০ জন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক ছিলেন। যাঁরা এখন দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে নিয়মিত কাজ করছেন।