- বাংলাদেশ
- ডিম-মুরগির দামের নাটাই কার হাতে
ডিম-মুরগির দামের নাটাই কার হাতে

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ছোট্ট একটি ভাড়া বাসায় দুই ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন আহসান উল্ল্যাহ। পাঁচ বছর ধরে ভোলার এ বাসিন্দা রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তাঁদের আমিষের মূল উৎস ছিল ব্রয়লার মুরগি ও ডিম। কিন্তু এখন যদি ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়ার ইচ্ছা হয়, তাহলে এক কেজি কিনতে গুনতে হয় ২৫০ টাকা। এই টাকা দিয়েই ৫ কেজি মোটা চাল কেনা যায়। মুরগির পরিবর্তে তেলাপিয়া বা চাষের পাঙাশ মাছ কেনার কথা ভাবলেও কিন্তু খুব একটা লাভ হচ্ছে না। এর দরও বেড়ে গেছে, প্রতি কেজি পাঙাশ ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। তাহলে কি কেবলই ডিম? এখানেও দুঃসংবাদ, এরও দাম বাড়ছে, প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা।
ডিম-মুরগির দাম এই বাড়ে তো, এই কমে। কারা দাম নির্ধারণ করেন, কেন ঠকছেন ভোক্তা– তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চললেও দায় নিতে চান না কেউই। অনেকের অভিযোগ, দামের চাবি নাড়ায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি। আবার ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন খরচ সামাল দিতে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। খরচ সামলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে ২০ হাজার খামার। চাহিদা অনুযায়ী জোগান না থাকায় বাজার ঊর্ধ্বমুখী।
পোলট্রি খাদ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে: ডিম ও মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ার দুটি কারণ বলছেন ব্যবসায়ীরা– এক. মার্কিন ডলারের দামের কারণে পোলট্রি খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি। দুই. চাহিদা বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে কম সরবরাহ।
গাজীপুরের ইউনাইটেড এগ্রো কমপ্লেক্সের স্বত্বাধিকারী খন্দকার মহসিন বলেন, তাঁর খামারের প্রতি চালানে (মুরগির উৎপাদন সময়কাল) উৎপাদনসক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মুরগি। গত সেপ্টেম্বরে তাঁর উৎপাদন ছিল ৭৭ হাজার। সেটি এখন ৫৫ হাজারে নেমে এসেছে।
ফিড মিল মালিকদের সংগঠন ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব) সূত্রে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে গড়ে প্রতি মাসে পৌনে ৫ লাখ থেকে ৫ লাখ টন পশু খাদ্য উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত শীর্ষস্থানীয় ১০ কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ৩ লাখ টন পশু খাদ্য উৎপাদন করা হয়। কিন্তু গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে পশু খাদ্য উৎপাদনের প্রধান তিনটি উপকরণের দাম ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে প্রতি প্রাণিজ খাদ্যের দাম ১৬০ শতাংশ পর্যন্ত।
পোলট্রি ফিডের (ব্রয়লার) প্রতি কেজি ২০২০ সালে ছিল ৪৮ টাকা, ২০২১ সালে ৫২ টাকা, ২০২২ সালে ৬৫ টাকা, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে হয়েছে ৭৩ টাকা। দুই বছরে দাম বেড়েছে ২৫ টাকা। পোলট্রি ফিড (লেয়ার) ২০২০ সালে ছিল ৩৯ টাকা, ২০২১ সালে ৪৩ টাকা, ২০২২ সালে ৫৮ টাকা আর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে হয়েছে ৬৭ টাকা। পোলট্রি ফিড (সোনালি) ২০২০ সালে ৪২ টাকা, ২০২১ সালে ৪৬ টাকা, আর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে হয়েছে ৬৭ টাকা। দুই বছরে এ খাদ্যের দাম বেড়েছে ২৮ টাকা।
সিন্ডিকেটের অভিযোগ : মোটা দাগে তিন ধাপে অর্থাৎ এক দিনের বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা খামার, মুরগি বা ডিম উৎপাদনকারী এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িতদের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হয় গোটা প্রক্রিয়া। ফলে এর যে কোনো একটি চেইনে সংকট দেখা দিলে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়ে যায়। এক দিনের বাচ্চা নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান। বাকি ধাপগুলো পরিচালিত হয় প্রায় দেড় লাখ প্রান্তিক খামারি ও বাজারজাতকারীর মাধ্যমে। তবে ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই বাজারে সব মুরগির দাম চড়া। এক দিনের বাচ্চার দাম বেড়েছে ৮ গুণ। বর্তমানে ব্রয়লারের এক দিনের বাচ্চার দাম এখন ৫৬ টাকা। অথচ জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহেও বাচ্চার দাম ছিল মাত্র ৯ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিদিন সকালে গাজীপুর, সাভার, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার ও কাপ্তান বাজারের ব্যবসায়ীরা ফোনে একে অন্যের সঙ্গে পরামর্শ করে ডিম ও মুরগির দর নির্ধারণ করেন। যার প্রভাব পড়ে প্রায় সারাদেশে।
এ বিষয়ে গাজীপুরের সোনার বাংলা পোলট্রি খামারের মালিক ইদ্রিস আলী জানান, উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে মুনাফার বিষয়টি নিশ্চিত করতেই পরামর্শ করি। এটাকে সিন্ডিকেট বলা ঠিক নয়।
দায় নিতে চায় না কেউ: রমজানকে কেন্দ্র করে চাহিদা আরও বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও আতঙ্ক বিরাজ করছে প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে। অস্থিরতার কারণে কিছুটা দাম পাওয়ার আশায় ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ব্রয়লারও বিক্রি করে দিচ্ছেন অনেক খামারি। এ অবস্থায় আজ রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান জানান দেবে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) এক নেতা বলেন, দাম বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। কিন্তু আসল কারণ কেউ খুঁজে বের করে না। পরিবহন ভাড়া দ্বিগুণ বেড়েছে। আগে যেখানে ১৭ হাজার টাকায় এক গাড়ি নেওয়া যেত, সেই গাড়ির ভাড়া এখন ২৭ হাজার টাকা। আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ায় মুরগির খাবার প্রসেস করার খরচও বেড়েছে। ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পেরে প্রাণিজ খাদ্য আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে।
তদারকি করবে কে: মাসতিনেক আগে ডিমের বাজারে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকও হয়। কিন্তু এখন আর সেই তৎপরতা নেই। উৎপাদন, চাহিদা ও মজুত নিয়ে সরকারি সংস্থার কাছে নেই কোনো তথ্য। ফলে নানা সময়ে দাম বৃদ্ধি, বাজারে সংকট এবং নৈরাজ্য অবস্থা তৈরি করে অর্থ হাতিয়ে নিলেও দেখার কেউ নেই।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, বাজারে ডিম ও মুরগির দাম ঠিক কত হলে যৌক্তিক হবে, সেটি নির্ধারণ করা নেই। তবে সরকার যেসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়ে থাকে, সেসব পণ্যের দামে ক্রেতারা ঠকছেন কিনা, সেটি নিয়মিতভাবে তদারক করা হয়। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, শিগগির আইন সংশোধন করে অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় মুরগি ও ডিম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, পোলট্রি অ্যানিম্যাল ফিডের যেসব উপকরণ বিদেশ থেকে আনতে হয়, সেসব আনার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এসবের কারণে প্রাণিজ খাদ্যের দাম বেড়েছে। দেশের ভেতরে যাতে বিকল্প খাদ্য তৈরি করা যায়, সে জন্য সাভারে নতুন কারখানা স্থাপন করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন