বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একদিকে মানুষের রক্ত ঝরেছে, অন্যদিকে আলোড়ন চলেছে বিশ্বজুড়ে। সেই জটিল ও কঠিন সময়ের আঁচ দিতে সমকাল ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা নথি এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে প্রকাশিত বই নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। আজ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৭১-এর ৫ মার্চের মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোভাব ও পদক্ষেপ নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মূল্যায়নের বাছাই অংশ।

অনুবাদ ও গ্রন্থনা : ফারুক ওয়াসিফ ১৯৭১ সালের ২৫ বা ২৬ মার্চে কী ঘটবে, তা তখনও অজানা। পশ্চিমা কূটনীতিকরা গভীর উদ্বেগ ও উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন ৭ মার্চের দিকে। সকলেরই অনুমান, বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এদিন হয় সরাসরি স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনীয় কোনো ঘোষণা দেবেন? দেশি-বিদেশি পক্ষগুলোর ভয় ছিল, ৭ মার্চ থেকেই নেমে আসবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দমন অভিযান। ঠিক তার দু’দিন আগে, ৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকো দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি রজার্সের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের চলমান পরিস্থিতিতে করণীয় কী– তা নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত স্মারক পাঠান। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা ঠেকাতে সামরিক অভিযান আসন্ন বলে তাতে হুঁশিয়ারি জানানো হয়।

আজকে সেই গোপন প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো: পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা ঠেকাতে পাকিস্তান সরকারের সামরিক অভিযানের সম্ভাবনা বিষয়ে ইসলামাবাদের (মার্কিন) দূতাবাসের মূল্যায়ন আমরা পেয়েছি। আমাদের বিশেষ পরিস্থিতি বিষয়ক দলিল এবং গতকাল আপনার কাছে পাঠানো আমার স্মারকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দিক থেকে সামরিক অভিযানের যতটুকু সম্ভাবনা আছে বলে আমরা হিসাব করেছিলাম, আমাদের দূতাবাস বিশ্বাস করে এখন সেই সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি। দূতাবাস হিসাব করে দেখেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যদি এই উপসংহারে আসে যে দেশকে এক রাখার একমাত্র উপায় হলো বলপ্রয়োগ, তবে তার জন্য তারা প্রস্তুত। দূতাবাস আমাদের খতিয়ানের সঙ্গে একমত যে, বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাঙালিদের বিক্ষোভ দমন অথবা জনপ্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের বিচ্ছিন্নতাকামী পদক্ষেপের পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থানে নেই পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী। সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য শক্তিপ্রয়োগ করছে। এমন আলামতও রয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সীমিত সামর্থ্য জোরদার করতে তারা তৎপর রয়েছে, যদিও বড় আকারে তা করার কোনো প্রমাণ এখনও নেই।

সমীকরণে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে বাঙালিদের বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমনের বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনমতের প্রতিক্রিয়া। এ বিষয়ে দূতাবাস এই উপসংহারে এসেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃত্বকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সেনাবাহিনী যদি ত্বরিত পদক্ষেপে বিচ্ছিন্নতা দমন করতে পারে, তাহলে এমন ব্যবস্থাকে সাধারণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ঐক্য রক্ষায় দরকারি পদক্ষেপ হিসেবে মেনে নেবে। কিন্তু প্রতিরোধ বিস্তৃত হয়ে পড়লে পশ্চিম পাকিস্তানিরা হয়তো বাঙালিদের জোর করে ধরে রাখার বদলে তাদেরকে তাদের পথে যেতে দিতে চাইবে।

সকল আভাস বলছে, ৭ মার্চের বক্তৃতার মাধ্যমে শেখ মুজিব চূড়ান্ত অবস্থান নিয়ে ফেলবেন এবং স্বাধীনতার সমতুল্য কার্যক্রম চালানোর ডাক দেবেন। যেমন– পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা একটি সংবিধান ও সরকার তৈরি করা, যা আবার পশ্চিম পাকিস্তানের একই ধরনের সরকারের সঙ্গে আলগাভাবে জড়িত থাকবে, যদি কমনওয়েলথ বা কনফেডারেল বন্দোবস্তের সমাধান বের করা যায়। মুজিবের ঘোষণার প্রতি সামরিক আইন প্রশাসন কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, তার ওপরই নির্ভর করবে শান্তিপূর্ণ রূপান্তর অথবা বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাতের সম্ভাবনা।

বর্তমান আলামতের ওপর ভিত্তি করে আমরা কোনো পূর্বাভাস দিতে পারছি না যে, সামরিক বাহিনী আসলে কী করবে। যতই সহিংস ও নিষ্ফল হোক, তারা মরিয়া পদক্ষেপ নিতে পারে। দৃশ্যত, ইয়াহিয়া এখনও সমঝোতামূলক সমাধানে আসার চেষ্টা যদিও বাতিল করে দেননি। তিনি আজ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক করছেন এবং আগামীকাল (৬ মার্চ) জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণ দেওয়ার কর্মসূচিও নির্ধারিত রয়েছে। মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য তিনি ৬ মার্চ ঢাকায় যাচ্ছেন বলে আরেকটি খবরও রয়েছে।

এখন থেকে আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের তিনটি মাত্রা দেখতে পাচ্ছি। সেনাবাহিনী এখন যেমন করছে, তেমন করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখার মধ্যে সীমিত থাকতে পারে এবং মুজিব যা করবেন, তা মেনে নেওয়া হবে। অথবা পূর্ব পাকিস্তানে বর্তমানে তাদের যে সীমিত সামর্থ্য রয়েছে, তা দিয়েই বিচ্ছিন্নতা ঠেকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। কিংবা পূর্বে তাদের শক্তি পূর্ণমাত্রায় বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে দীর্ঘমেয়াদি দমনমূলক অভিযান চালানো।

আমাদের স্বার্থের দিক থেকে পূর্বে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টায় হস্তক্ষেপ করা আমাদের জন্য ঠিক হবে না। বাঙালিদের স্বাধীনতার দাবিকে যদি সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দমন করা হয়, তাহলে গণসহিংসতা ও রক্তপাত ঠেকাতে আমাদের গুরুতরভাবে জড়িত হতে হবে। জরুরিভাবে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহিংসতা বন্ধ করার প্রশ্নে কথা বলার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হোক। তা হতে পারে অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশ, যেমন– ব্রিটেন ও জাপানের সঙ্গে একযোগে সহিংসতা বন্ধের জন্য আহ্বান জানানো।

সূত্র: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মহাফেজখানার ওয়েবসাইট এবং ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস ১৯৫৩-১৯৭৩, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যান্ড স্ট্রাগল ফর ইনডিপেন্ডেন্স, হাক্কানি পাবলিশার্স, ঢাকা, মার্চ ২০১৩ সংস্করণ।