- বাংলাদেশ
- ‘রক্তস্নান করবে পূর্ব পাকিস্তান’
‘রক্তস্নান করবে পূর্ব পাকিস্তান’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একদিকে মানুষের রক্ত ঝরেছে, অন্যদিকে আলোড়ন চলেছে বিশ্বজুড়ে। সেই জটিল ও কঠিন সময়ের আঁচ দিতে সমকাল ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা নথি এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে প্রকাশিত বই নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। আজ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৭১-এর ৬ মার্চের মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোভাব ও পদক্ষেপ নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মূল্যায়নের বাছাই অংশ। অনুবাদ ও গ্রন্থনা : ফারুক ওয়াসিফ
৭ মার্চের ঠিক আগে, ৬ মার্চ ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে আরেকটি বিশেষ বৈঠক বসে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার এতে সভাপতিত্ব করেন। ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ঠিক করাই ছিল এই বৈঠকের উদ্দেশ্য। বৈঠকে আরও ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পিয়ার্স রজার্স, রাজনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আলেক্সিস জনসন। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন হ্যারল্ড স্যান্ডার্স, স্যামুয়েল হসকিনসন, কর্নেল রিচার্ড কেনেডি, জিয়ান ডব্লিউ ডেভিস। ছিলেন নিকটপ্রাচ্যবিষয়ক ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন। সিআইএ থেকে ছিলেন রিচার্ড হেমস ও ডেভিড এইচ ব্লি। প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে ছিলেন ভাইস অ্যাডমিরাল জন উয়েইনেল ও কর্নেল জেমস কনেল।
বৈঠকের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো:
মি. কিসিঞ্জার: আমি ভেবেছিলাম, সামনে কী আছে এবং মূলত আমাদের কী করা থাকতে পারে– তা নিয়ে আমরা সংক্ষিপ্ত বৈঠক করব। আমার ধারণা, আগামীকাল আমরা কিছু জানতে পারব।
মি. জনসন: আমাদের কাছে ভালো একটা আন্তঃসংস্থা বিশেষ পরিস্থিতি পরিকল্পনাপত্র রয়েছে।
মি. কিসিঞ্জার: জ্বি, এটা ভালো একটা দলিল।
মি. জনসন: পরিস্থিতি যা তাতে আমরা ইতোমধ্যে পরিকল্পনাপত্রের ৭ নম্বর পৃষ্ঠার অংশে আছি। আমি দুটি বিষয়ে বলতে চাই। প্রথমত, এটা পূর্ব-পশ্চিম বা যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত অথবা যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সংঘাত নয়। যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত সবারই স্বার্থ হলো, পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখা এবং ভাঙন থেকে কারোরই লাভবান হওয়ার কিছু নেই। দ্বিতীয়ত, ঘটনাবলির ওপর আমাদের এমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা পরিণতিকে ঠিক করে দিতে পারে, আমাদের প্রভাব খুবই কম। আগামীকাল শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর আমরা আরও ভালোভাবে অবগত হবো। আমাদের দূতাবাস ইয়াহিয়ার আজকের ভাষণকে চিনি ও তিতার মিশেল বলে বর্ণনা করেছে। যদি সমস্যাটা (স্বাধীনতা ঘোষণা-অনুবাদক) কিছুদিনের জন্য স্থগিত থাকে, তাহলে আমরা তাৎক্ষণিক সমস্যার মুখে পড়ব না। মুজিব যদি আমাদের কাছে আসেন এবং একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পরিকল্পনার কথা বলে জিজ্ঞাসা করেন যে আমাদের অবস্থান কী– তখন কী বলা হবে, তা নিয়ে আমরা সমস্যায় পড়ব। যদি ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে বলপ্রয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যান, তাহলে আমরা কী অবস্থান নেব– তা ঠিক করতে হবে। আমাদের সবার মূল্যায়ন এই, যে পরিমাণ সৈন্য আছে (১২ হাজার যোদ্ধাবাহিনীসহ মোট ২০ হাজার) এবং পূর্ব পাকিস্তানের যে সাড়ে সাত কোটি ক্রুদ্ধ জনগণ, সব মিলিয়ে ফলাফল হবে এমন এক রক্তস্নান, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার কোনো আশাই থাকবে না। এ ঘটনায় সহিংসতা বন্ধেই আমাদের স্বার্থ থাকা উচিত। কিন্তু প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে যে আমরা, নাকি অন্যরা এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দেবে– তা এখন দেখার অপেক্ষায়। আজ বিকেলে আমরা ব্রিটিশদের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলাম। মুজিব অতুলনীয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পেয়ে গেছেন, গত নির্বাচনে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি পেয়ে গেছেন। এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। আমরা দেশটিকে মেলানো ও ঐক্যবদ্ধ করা যেতে পারে বলে ভঙ্গি নিয়ে থাকলেও সেই সম্ভাবনা এখন অতি সামান্য। তারা কীভাবে আলাদা হয়ে যাবে এবং কোন মাত্রায় ভাঙন সম্পন্ন হবে অথবা অস্পষ্ট শর্তে কনফেডারেল অবস্থায় থাকবে– তা এখন কেবলই সময় ও পরিস্থিতির ব্যাপার।
৬ মার্চ ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছেন, জাতীয় পরিষদের সভার তারিখ তিনি ২৫ মার্চ বলে ঠিক করেছেন। এই বলে তিনি তাঁর ভাষণ শেষ করেন যে, যত দিন তিনি সেনাবাহিনীর দায়িত্বে আছেন, তত দিন তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা পাহারা দিয়ে যাবেন।
সূত্র: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মহাফেজখানার ওয়েবসাইট
আগামীকাল দেখুন: ইয়াহিয়াকে অবজ্ঞা করো না: কিসিঞ্জার
মন্তব্য করুন