মিয়ানমারে ২০১৭ সালের আগস্টে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকেই সরকারের তত্ত্বাবধানে কাজ করে আসছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা। সেই থেকে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার জন্য জাতিসংঘ যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা বা জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) তৈরি করে আসছে। ২০২২ সালের জেআরপিতে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টিতে জোর দিয়েছিল জাতিসংঘ। তবে এ বছরের জেআরপিতে অগ্রাধিকার থেকে বাদ পড়ছে সংহতি ও সুসম্পর্কের বিষয়টি।

২০২৩ সালের খসড়া জেআরপি অনুযায়ী, রোহিঙ্গা ও স্থানীয় মোট ১৫ লাখ ২০ হাজার মানুষের জন্য ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারের চাহিদার কথা দাতাদের জানানো হবে। পাঁচটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে এ অর্থ খরচ করা হবে। ১৬০টি প্রকল্পে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোসহ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ১১৬টি প্রতিষ্ঠান কাজ করবে।

গত বছর প্রথমবারের মতো ভাসানচরের জন্য বাজেট রাখা হয়েছিল। এবারও ভাসানচরের জন্য ৬ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের চাহিদা ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে ৭৫ হাজার রোহিঙ্গার জন্য এ চাহিদার কথা বলা হয়েছে। তবে জাতিসংঘের হিসাবে বর্তমানে দ্বীপটিতে ২৯ হাজার ৩৪০ রোহিঙ্গা রয়েছে। গত বছর ভাসানচরের জন্য প্রায় ১০ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছিল।

রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ার পর ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক সহায়তা সবচেয়ে কম এসেছিল। সে বছর পাওয়া যায় চাহিদার প্রায় ৬২ শতাংশ। এর আগে ২০১৭ সালে চাহিদার ৭৩ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৭২, ২০১৯ সালে ৭৫, ২০২০ সালে ৬৫ এবং ২০২১ সালে চাহিদার ৭২ শতাংশ অর্থ সহযোগিতা পাওয়া গেছে।

গত বছর মানবিক সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘাত ঠেকাতে কমিউনিটি সুরক্ষা ফোরাম, কমিউনিটিভিত্তিক সংলাপ এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের মধ্যে যোগাযোগ শক্তিশালী করতে কাজ করেছে। ২০১৭ সালের পর থেকেই রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা করে আসছে জাতিসংঘ। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা সেখানে অনেক সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে। তহবিল কমে আসায় রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। জাতিসংঘ চাচ্ছে প্রকল্পগুলো সাশ্রয়ীভাবে পরিচালন করতে। সেসঙ্গে রোহিঙ্গারা যাতে জীবিকার ব্যবস্থা নিজেরাই করতে পারে, সে ধরনের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প নিতে চায় তারা।

জাতিসংঘ বলছে, খাদ্যসহায়তা কমে গেলে রোহিঙ্গারা আরও মরিয়া হয়ে উঠবে, ক্যাম্পগুলোতে সহিংসতা এবং অস্থিরতা বাড়াবে। এ ছাড়া মানব পাচারের শিকার হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে রোহিঙ্গারা, বিশেষ করে শিশু এবং মেয়েরা। তহবিল কমে আসার প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, খাবারের বাজেট কমে এলে, তা পুষ্টিতে প্রভাব ফেলবে। এমনিতেই রোহিঙ্গারা অপুষ্টিতে ভুগছে। রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে কাজ খুঁজলে বাংলাদেশের জন্য সংকট তৈরি হবে। রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে সংহতি অর্জনের যে চেষ্টা, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে সংহতি ও সুসম্পর্ক স্থাপন অগ্রাধিকার থেকে বাদ পড়া নিয়ে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, তহবিল কমে আসায় রোহিঙ্গাদের খাদ্যের তালিকাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অনেক কিছুই কমিয়ে আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে খাদ্য, পুষ্টি, শিক্ষার মতো বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এবার রোহিঙ্গাদের জীবিকা ও দক্ষতা উন্নয়নে ১ কোটি ১২ লাখ ডলার চাওয়া হবে।

জেআরপি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ৭ মার্চ জেনেভায় জেআরপি প্রকাশ করা হবে। জেআরপির বিস্তারিত প্রকাশের পর বিষয়টি স্পষ্ট হবে। তবে রোহিঙ্গা সহায়তা কমতে থাকলে আগামী মে মাসে খাদ্যের সহযোগিতা অর্ধেকে নেমে আসবে।