- বাংলাদেশ
- কিডনি রোগীর মৃত্যু বেড়ে দ্বিগুণ এক বছরেই
কিডনি রোগীর মৃত্যু বেড়ে দ্বিগুণ এক বছরেই
বিশ্ব কিডনি দিবস আজ

দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে ভুগছে। তাদের মধ্যে বছরে ৪০ হাজার রোগীর কিডনি পুরোপুরি বিকল হচ্ছে। ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া এসব রোগীর আর কোনো চিকিৎসা নেই। তবে কিডনিদাতার সংকটে অনেকেই ডায়ালাইসিস চিকিৎসা বেছে নেন। সরকারি পর্যায়ে গত ৮ বছরে ডায়ালাইসিসের খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য না থাকায় অনেকেই মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এতে অপ্রত্যাশিত মৃত্যু বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের তুলনায় গত বছর কিডনি রোগীর মৃত্যু হার বেড়েছে দ্বিগুণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগী বাড়লেও সেই অনুযায়ী সেবার পরিধি ও সক্ষমতা বাড়েনি। দেশে কিডনি বিকল রোগীর মধ্যে ডায়ালাইসিসের সুযোগ পাচ্ছেন ২৫ শতাংশ। এ সেবা ৮০ শতাংশই শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগ (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ) বাড়ছে। এসব রোগের কারণেও রোগীর কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিডনি রোগীর সেবার পরিধি ও দক্ষ জনবল দ্রুত বাড়ানো না হলে ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়বে।
দেশে ডায়ালাইসিস গ্রহণকারীর রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও সরকারিভাবে ডায়ালাইসিস মেশিন না বসিয়ে ২০১৫ সালে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় ভারতের স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসকে ভর্তুকি দিয়ে সেবা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঢাকার কিডনি ইনস্টিটিউটে ৫৯টি ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩১টি ডায়ালাইসিস মেশিন আছে প্রতিষ্ঠানটির। প্রথমে ২ হাজার ৭৮৫ টাকায় যে ডায়ালাইসিস সেশন পেত রোগীরা, বর্তমানে তাতে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা খরচ হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, প্রতিমাসে আগে ৮টি সেশনে ৫০০ টাকা ভর্তুকি মূল্যে ডায়ালাইসিস করা হতো। এখন ৪টি করতে হবে পুরো ফিতে। এ খাতে সরকার ভর্তুকিও কমিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালে সারাদেশে সরকারি হাসপাতালে ১৫ হাজার ৪২৭ জন কিডনি রোগ নিয়ে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে মারা গেছে ৫৪১ জন। গত বছর কিডনি রোগী ছিল ৩৩ হাজার। তাদের ১ হাজার ২৭ জন মারা গেছে।
এ রকম প্রেক্ষাপটে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য, অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের প্রস্তুতি, প্রয়োজন ঝুঁকিপূর্ণদের সহায়তা’। কিডনি রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে আজ বিভিন্ন সংগঠন র্যালি ও আলোচনা সভা করবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সকালে রাজধানীর শাহবাগ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব কনভেনশন হলে আলোচনা সভা হবে।
দিবসটি উপলক্ষে বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, কিডনি রোগের ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বাণীতে বলেন, নানাবিধ কারণে বিশ্বজুড়ে কিডনি রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। কভিড-১৯ মহামারিতেও অনেকে নতুন করে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন অথবা আগে থেকেই আক্রান্ত ব্যক্তিদের রোগের অবনতি হয়েছে। তাই এ ধরনের দুর্যোগ পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
বুধবার রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে (নিকডু) দেখা যায়, ঝিনাইদহের ৩২ বছর বয়সী উজ্জল মিয়া ডায়ালাসিস সেবা নিতে এসেছেন। তাঁর দুটি কিডনিই অকেজো। তিনি জানান, বেসরকারিভাবে চড়া দামে ডায়ালাইসিসের পেছনে টাকা খরচ করতে গিয়ে আর পারছেন না। সরকারিভাবে কিছুটা কম দরে ডায়ালাইসিস সেবা পেতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আবেদন করেন। তবে গতকাল পর্যন্ত তাঁর সিরিয়াল আসেনি।
সাভারের বাসিন্দা রমজান আলী ডায়ালাসিস করান দুই বছর ধরে। চিকিৎসক প্রতি সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিসের পরামর্শ দিলেও অর্থাভাবে তা করাতে পারেন না। মাঝখানে ছয় মাস টাকার অভাবে ডায়ালাইসিস সেবা নেওয়া একবারেই বন্ধ করে দেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে এক সপ্তাহ আগে কিডনি হাসপাতালে ভর্তি হন। সোমবার তাঁর মৃত্যু হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিডনি চিকিৎসার একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান নিকডুতে ডায়ালাইসিসের জন্য আবেদনের স্তূপ জমেছে।
চিকিৎসা সংকট : জেলা পর্যায়ে কিডনি রোগের চিকিৎসা নেই। দেশের বড় বড় হাসপাতালে এ রোগের জন্য নেই আলাদা কোনো ইউনিট। দেশে সব মিলিয়ে ১৬৫ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। পুরোনো আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সবক’টিতে আবার ডায়ালাইসিস সেন্টার নেই। নিকডু ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল, কুর্মিটোলা, সোহরাওয়ার্দী, মুগদা, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা আবু নাসের, সিরাজগঞ্জ মেডিকেলে ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু আছে।
নিকডুর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, আগামী এপ্রিলে তাদের হাসপাতালে আরও ২৫০ শয্যা বাড়ানো হচ্ছে। সরকারিভাবে অন্যান্য হাসপাতালে দেড় হাজার শয্যার ডায়ালাইসিস সেবা সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। সব মেডিকেল কলেজে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ২২টি ইউনিট ও জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যাবিশিষ্ট ৪৪টি ইউনিট থাকবে। নিকডুতে প্রতি শনিবার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হবে।
বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহম্মদ রফিকুল আলম বলেন, একজন রোগীর বছরে ডায়ালাইসিসে খরচ হয় দু-তিন লাখ টাকা। ব্যয় বেশি হওয়ায় দেশের ৯০ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিস করাতে পারে না। ডায়ালাইসিস শুরুর এক বছরের মধ্যে ৭০ শতাংশ রোগী তা ছেড়ে দেয়। কিডনি রোগীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর হার কমাতে কার্যকরী উদ্যোগ জরুরি। ৭৫ শতাংশ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও বিষয়টি বুঝতে পারে না।
অপ্রতুল কিডনি প্রতিস্থাপন : দেশে নিয়মিতভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। তবে দাতা সংকটে কিডনি প্রতিস্থাপন চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এ বছর ১৮ জানুয়ারি দেশে প্রথম মরণোত্তর দানের কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে সাড়ে তিন হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়েছে।
মন্তব্য করুন