- বাংলাদেশ
- দুর্ঘটনা নাকি অন্য কিছু
দুর্ঘটনা নাকি অন্য কিছু

গত শনিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুলে অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণের পরের দিন ঢাকার সায়েন্স ল্যাবে মার্কেটে একইভাবে রক্ত ঝরে। দুই ঘটনার ১০ জনের মৃত্যুর শোক না কাটতেই মঙ্গলবার সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে হতাহত হয়েছেন বহু মানুষ। একের পর এক বিস্ফোরণ অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায়, নাকি অন্য কোনো কারণে– এ প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাশকতার আলামত না পেলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জল্পনা এবং রাজনৈতিক বক্তব্য থেমে নেই। বিরোধী দলগুলো সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতিকে দায়ী করছে বিস্ফোরণের জন্য। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অভিমত, বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে নাশকতার দিকে গিয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে।
এ বক্তব্যকে অবশ্য দায়িত্বজ্ঞানহীন বলেছেন বিরোধীরা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেছেন, আগের ঘটনাগুলোতে স্পষ্ট, বিস্ফোরণ ঘটেছে অনিয়মের কারণে। সরকারি সংস্থাগুলো দুর্নীতির কারণে ঠিকঠাক নিরাপত্তা তদারকি করেনি। বর্তমান সরকারের সর্বক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে, তারই কুফল এসব বিস্ফোরণ ও প্রাণহানি। এতে বিরোধী দলকে টেনে এনে ব্যর্থতা আড়ালের চেষ্টা আওয়ামী লীগের পুরোনো চরিত্র।
অবসরপ্রাপ্ত আবহাওয়াবিদ মো. শাহ আলম জানিয়েছেন, ফাল্গুন ও চৈত্র বাংলাদেশের সবচেয়ে শুষ্ক মাস। বাতাসে জলীয়বাষ্প কম থাকায় এ সময়ে আগুন দ্রুত ছড়ায়। বন-জঙ্গলে একই কারণে এ সময়ে দাবানল দেখা যায়। দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় আগুন ছড়ানোর সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ কারণে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এ দুই মাসে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটে।
দুর্ঘটনাজনিত বিস্ফোরণের আরও যেসব কারণ জানা যায়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরজুড়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বৈধ-অবৈধ লাইন ছড়িয়ে থাকা। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলোতে লিকেজ রয়েছে। সরকারি সংস্থা এবং ভবন মালিকরাও পরিষেবা লাইনের পরিচর্যা করে না। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে ড্রেন ও স্যুয়ারেজ লাইন থেকে গ্যাস নির্গত হওয়ার পথ থাকে না। স্যুয়ারেজ লাইনের ওপর কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। ফলে গ্যাস জমে সেপটিক ট্যাঙ্কে। ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ লাইন বা অন্য কোনো উৎস থেকে সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গ জমে থাকা গ্যাসের সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরণ ঘটছে; আগুন ছড়িয়ে পড়ছে।
শীতকালে এসির ব্যবহার বন্ধ থাকে। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকা শীতাতপ যন্ত্রের সার্ভিসিং না করে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ব্যবহার করা হয়। একটি এসির গ্যাস লিক হলে আগুন থেকে আশপাশেরগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিস্ফোরণের কারণ দুর্ঘটনা, নাকি অন্তর্ঘাতমূলক– তার তদন্ত প্রয়োজন। সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন করে তিনি বলেছেন, কী কারণে একের পর এক বিস্ফোরণ, কেন এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হলো– সেটার সঠিক তদন্ত দরকার। ঘটনাগুলো কোনো কিছুর ইঙ্গিত কিনা, সেটাও আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাকে খতিয়ে দেখতে হবে।
নাশকতাতত্ত্ব উড়িয়ে দিচ্ছেন না ড. কামাল উদ্দিন। তিনি বলেছেন, অবাক হচ্ছি, বেসমেন্টের বিস্ফোরণে বহুতল ভবনের একাধিক তলা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কয়েক বছর আগেও দেখা গেছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরেছেও। তাই সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগ সিদ্দিকবাজারের ভবনে বিস্ফোরণের ক্ষেত্রের নাশকতার আশঙ্কা খারিজ করেছে। সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিটের ইনচার্জ (এডিসি) রহমত উল্লাহ চৌধুরী জানিয়েছেন, জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে। এ ধারণার পক্ষে পাঁচটি সম্ভাব্য কারণও তুলে ধরেছে সিটিটিসি।
সীতাকুণ্ডে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা সীমা অক্সিজেনে সীমাহীন অনিয়মের খবর সমকালে প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে নিরাপত্তা ত্রুটির জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সীমা অক্সিজেনকে নোটিশও করেছিল। বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে ঘটিত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান জানিয়েছেন, প্লান্টের ‘এয়ার সেপারেশন কলাম’ থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে। কারখানায় অনুমোদনহীন অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাশাপাশি কার্বন ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন সিলিন্ডারও পায় কমিটি।
সায়েন্স ল্যাবের বিস্ফোরণও জমে থাকা গ্যাসের কারণে ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে বোমা বা নাশকতার আলামত মেলেনি।
মন্তব্য করুন