দেশে শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু রয়েছে আনুমানিক এক কোটি। এর মধ্যে ২৩ লাখ শিশু ‘তীব্রতর’ অপুষ্টিতে (সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশন–স্যাম) ভুগছে। গত এক বছরে এ ধরনের শিশুর সংখ্যা আরও বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে হাসপাতালে ভর্তির হার। তবে এসব শিশুর পরিচর্যা সেবাকেন্দ্রের সংখ্যা ও সক্ষমতা বাড়েনি। বর্তমানে এ ধরনের শিশুর চিকিৎসায় দেশে ৪৩৬টি কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ কেন্দ্রেই কার্যকর সেবা মিলছে না।

শিশুর উন্নতি ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি গত বছরের ডিসেম্বরে করা হয়। এর আগে আরও তিনবার এ জরিপ করছে সংস্থাটি। জরিপটি করতে একটি স্যাম ইউনিটে ওজন ও উচ্চতা পরিমাপ যন্ত্র, সরবরাহ করা খাবার, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী নিবন্ধন ও রিপোর্ট এবং আলাদা শয্যা আছে কিনা– তা দেখা হয়েছে।

দেশে তীব্রতর অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সেবাদান কেন্দ্রগুলোর কী অবস্থা, তা জানতেই এ জরিপ করা হয়। গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে জরিপের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় পুষ্টিসেবার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. আব্দুল মান্নান।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গত বছর এ ধরনের মাত্র এক লাখ শিশুকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৮৩ শিশু। ২০২১ সালে স্যামে ভোগা শিশু ভর্তি হয় ১১ হাজার ৩১৩। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫৭০। ২০২১ সালে দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে আসা তীব্রতর অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ৭২ শতাংশ।

এসব শিশুর সেবাদানে ডব্লিউএইচওর গাইডলাইনের ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ২০১২ সালে স্যাম কর্নার চালু করা হয়। সারাদেশের এসব কর্নারের মধ্যে সেবাদানে সবচেয়ে পিছিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগের ১৭ শতাংশ কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গ সেবা দিতে পারছে না। এদিকে ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে ১৬ শতাংশ কেন্দ্রে পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু নেই। খুলনায় ১৫, রংপুরে ১৩, বরিশালে ৯ ও সিলেটে ৮ শতাংশ কেন্দ্রে পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু নেই।

জরিপে আরও দেখা গেছে, দিন দিন তীব্রতর অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বাড়লেও সেবাদানের জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এসব কেন্দ্রের ৬১ শতাংশ জনবল অদক্ষ। শুরুতে দক্ষ জনবল দিয়ে সেবাকেন্দ্র চালু হলেও বদলির কারণে এমন অবস্থা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এসব কর্নারে এখন শিশুর অপুষ্টি সমস্যার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উপকরণ ও থেরাপিউটিক খাবার (এফ-৭৫ ও এফ-১০০) সরবরাহ করা হচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ কেন্দ্রে এফ-৭৫ খাবার, ৭৪ শতাংশ কেন্দ্রে এফ-১০০ খাবার বস্তাবন্দি অবস্থায় পাওয়া যায়। এসব কেন্দ্রে রোগীরা এসে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও থেরাপিউটিক খাবার না পেয়ে ফিরে গেছেন।

আবার জাতীয় পুষ্টি সেবার (এনএনএস) কর্মকর্তরা বলেন, মাঝেমধ্যে থেরাপিউটিক খাবার এফ-৭৫ ও এফ-১০০-এর সংকটও থাকে। এই দুধজাত খাবার বাংলাদেশে তৈরি হয় না। এমনকি ভারতেও হয় না। ইউনিসেফ এ খাবার সরবরাহ করে।
বাংলাদেশ সৃষ্টি থেকে এ পর্যন্ত অপুষ্টি দূর করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ২০১২ সাল থেকে স্যাম কর্নারে শিশুর তীব্রতর অপুষ্টির চিকিৎসা শুরু করা হয়। তবে তীব্রতর অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সেবার মানে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ছয় মাসে দ্রব্যমূল্যের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। অনেকেই প্রয়োজনীয় পুষ্টির বিষয়টিতে আপস করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে আগামীতে তীব্রতর অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যা বাড়বে। তাই এখন থেকে এটি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

অপুষ্টিকে দেখা হয় শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নতির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তীব্র অপুষ্টি ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর অসুস্থতা ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। সারাবিশ্বে বছরে প্রায় দুই কোটি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়। আর ১০ লাখের মতো শিশুর মৃত্যু হয়। এসব শিশুর অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দা।

বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. খলিলুর রহমান সমকালকে বলেন, তীব্রতর অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা নিশ্চিত ও মৃত্যুঝুঁকি কমাতে সরকারের মহাপরিকল্পনা রয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এটি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে নির্ধারণ করা হয়। তীব্রতর অপুষ্টিতে আক্রান্তদের হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হয়। অনেকেই শিশুকে এত দিন হাসপাতালে রাখতে চান না।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাভাবিক শিশুদের থেকে তীব্রতর অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুঝুঁকি ১২ গুণ। নানা কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন– প্রসূতি নারী ও সন্তানের জন্মকালীন পরিচর্যার অভাবে শিশুর মধ্যে অপুষ্টি দেখা যেতে পারে। তবে এর প্রধানতম কারণ হিসেবে দেখা হয় নিয়মিত খাদ্য তালিকায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের অনুপস্থিতিকে।

এ অপুষ্টি চূড়ান্ত বা তীব্রতম মাত্রায় পৌঁছালে শিশুর শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. আব্দুল মান্নান সমকালকে বলেন, তীব্রতর অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর অভিভাবককে আরও সচেতন হতে হবে। এ কর্নারে ভর্তি শিশুর বেশির ভাগই দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত। শিশুর সঙ্গে মা অথবা বাবাকে থাকতে হয়। ভর্তি হওয়ার সপ্তাহের মাথায় যখন শিশুটি কিছুটা সুস্থ হয়, তখন তাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান তাঁরা।

বিষয় : অর্ধেক পরিচর্যাকেন্দ্রই অকার্যকর তীব্র অপুষ্টির শিকার শিশু

মন্তব্য করুন