দেশের বাজারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসামগ্রীর দাম। গত ৬ মাসে পণ্যভেদে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। নিত্যপণ্যের আগুন বাজারে মানুষের নাভিশ্বাস। এখন পঙ্গুত্বের মতো দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় বাড়তি ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। রোগীর স্বজনরা জানান, আয় ও ব্যয়ের ফারাক কয়েক গুণ হওয়ায় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এখন পঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসামগ্রী ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেভাবে চিকিৎসা উপকরণ ও ওষুধের দাম বাড়ছে, লাগাম না টানলে চলমান চিকিৎসা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হবে। রোগী নিয়ে পরিবারগুলো মানবিক সংকটে পড়বে। এ জন্য সরকারকে এখনই যথাযথ উদ্যোগ বিশেষ করে চিকিৎসা উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রে এলসি সহজ করতে হবে।

রাজধানীর ১০টির বেশি ফার্মেসি ও সার্জিক্যাল উপকরণ বিক্রির দোকান ঘুরে দেখা গেছে, আঘাতজনিত কারণে পায়ের গোড়ালি ও পাতায় ব্যথা কিংবা  হাঁটুর প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচারে ফুট ড্রপ ব্যবহার করা হয়। ভারতের টাইনর কোম্পানির ওষুধটি ৬ মাস আগেও ঢাকায় ৭০ টাকায় পাওয়া যেত। এখন কোথাও ১০০ টাকার নিচে মিলছে না। একইভাবে ঘাড় ব্যথায় ২০০ টাকার সার্ভাইক্যাল কলার ৩০০ টাকা, হাঁটু সোজা রাখার ২১০ টাকার নি-ক্যাপ ৩৫০, ১ হাজার ৮০০ টাকার নি-ব্যাচ ২ হাজার ৬০০ টাকা, ৩০০ টাকার হাঁটার ক্রাচস্টিক ৬০০ টাকা, ৬ হাজার ৫০ টাকার বাইপোলার হিপ সার্জিক্যাল ৭ হাজার ৫০ টাকা, ৫ হাজার বেড়ে মডুলার বাইপোলার ৪৫ ও অস্টিওটমিজ সার্জিক্যালের দাম ২ হাজার ৫০০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭০০ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রায় ৬০০ উপকরণের বেশিরভাগের দামই ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্ত্রোপচারের পর ভিটামিনের ঘাটতি দূরে ব্যবহৃত ভিটাবিয়ন ট্যাবলেট বি ১২-এর দাম ৮ থেকে ১০ টাকা, বোস্ট ট্যাবলেট ১০০ এমজি প্লাস ৩০ পিস ২৪০ থেকে ৩০০, কোরালক্যাল-ডি একফসিক্যাল-ডি ৫০০ মিগ্রা. ১০ পিস ৬০০ থেকে ৬৬০ ও কোরালক্যাল-ডি এক্স ৬০০ মিগ্রা. ১০ থেকে বেড়ে ১১ টাকা হয়েছে।

শ্যামলী সার্জিক্যাল স্টোরের কর্মকর্তা সঞ্জয় দে বলেন, ‘৬ মাসে দুই দফা এসব উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, ডলার সংকট ও এলসি খুলতে জটিলতার কারণেই দাম বাড়ছে।’

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা রায়হান জামান মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় গুলশান-১ আহত হন। তিনি এক মাস রাজধানীর শ্যামলীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাম পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। এরই মধ্যে আড়াই ২ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এখন তাঁর চিকিৎসা কীভাবে চালাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পরিবার। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে বছরে যে সংখ্যক মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করছেন, তার বড় অংশই সড়ক দুর্ঘটনায়। তাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত। বাকি ৭০ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য কারণে পঙ্গুত্ববরণ করছেন। এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব পঙ্গু দিবস।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে পঙ্গু হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পঙ্গু রোগী চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তিদের বেশিরভাগই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। এখানে প্রায় সবাইকে একই ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রোগীর স্বজনরা ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণের দাম বাড়ার কথা জানান।

পঙ্গু হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, সড়কসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় গত বছর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৭২ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩২ হাজার ৫০০ রোগীকে ভর্তি হতে হয়। যদিও চিকিৎসা নেওয়া কত শতাংশ রোগী স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এমনকি দেশে বছরে কতজন পঙ্গুত্ববরণ করছেন, তার সঠিক তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই।

পঙ্গু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সব পণ্যে পড়েছে। পঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ ও উপকরণের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় স্বজনরা চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।’ দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় সারাদেশে ৭টি ট্রমা সেন্টার করা হলেও দীর্ঘ ১৬ বছরে এগুলো কার্যকর করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহতরাই বেশি পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছেন। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো গেলে পঙ্গুত্বের হারও কমে আসত।’