পশ্চিমারা ইউক্রেনে যে হাজারও কোটি ডলারের অস্ত্রে খরচ করেছে, তা শুধু সংঘাতকে ঘনিভূত করেছে। তার পরিবর্তে এ অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য খরচ করা যেত বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। তিনি বলেন, বর্তমানে অর্থের অভাবে তাদের খাদ্য খরচ মাসে ১২ ডলার থেকে কমে ১০ ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

মঙ্গলবার ‘বসন্ত সংলাপ’ এর আয়োজন করে ঢাকার চীন দূতাবাস। এতে উপস্থিত থেকে গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। সংলাপটি সহ আয়োজক ছিল ইংরেজি দৈনিক দ্যা বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাড (টিবিএস)। সংলাপটি সঞ্চালনা করেন টিবিএসের সম্পাদক ইনাম আহমেদ।

চীন কেন মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে রাজি করাতে পারছে না- জানতে চাইলে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা সংকট হওয়া উচিৎ ছিল না। বাংলাদেশ এ জন্য বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার সমস্যা নয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে চীন সংকট সমাধানে তার ভূমিকা পালন করে আসছে। আমরা এ সংকট সমাধানে তৃপক্ষীয় বৈঠক চালু করেছি। এ নিয়ে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকে বসেছিল ২০১৭ সালে। কিন্তু করোনার কারণে এটি নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, ২০২১ এর আগে প্রথম পর্যায়ের প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, আপনারা জানেন এরপর মিয়ানমারে কী হয়েছিল, যার কারণে পুরো প্রক্রিয়া পিছিয়ে গেছে। আর এখন প্রক্রিয়া বেশ জটিল হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার আস্থার অভাবে। এর পাশাপাশি বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। তবে এখন সময় এসেছে সবাইকে মিলে একত্রে চেষ্টা করার, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক দাতাদের। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের অর্থায়ন কমে যাওয়া চিন্তার বিষয়। পশ্চিমারা হাজারও কোটি ডলারের অস্ত্র ইউক্রেনে খরচ না করে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় খরচ করতে পারত। ইউক্রেনে সামরিক সরঞ্জামের খরচ শুধু সংঘাত ঘনিভূত করেছে।

চীনের উদ্যোগে গ্লোবাল ডেভেলপমন্টে ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই) নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে জানতে চাইলে জিএসআইয়ের বিষয়টি এড়িয়ে যান ইয়াও ওয়েন। তবে জিডিআই নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এ প্রক্রিয়ায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন। আর এতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে ঢাকা।

বেল্ট অ্যান্ড রোডে (বিআরআই) বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে জানতে চাইলে ইয়াও ওয়েন বলেন, এ উদ্যোগের ১০ বছর চলছে। গত ১০ বছরে বিআরআই বিশ্বজুড়ে বেশ ভালো অগ্রগতি করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আর এ উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৮ম চীন-বাংলাদেশ সেতু। এ ছাড়াও বেশ কিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে।

বাংলাদেশে চীনের আগামী বিনিয়োগ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ বিজনেস সামিটে চীনের বিভিন্ন ৪০ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। তারা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুঁজে গিয়েছেন। চীন বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার। তাই বাংলাদেশের অগ্রধিকারের সঙ্গে মিলিয়ে বিনিয়োগ বিবেচনা করছে। ২০৪১ সালে যখন উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তখন বাংলাদেশ নিজেকে স্মার্ট হিসেবে দেখতে চায়। ফলে চীনের বিনিয়োগের অগ্রাধিকারে তথ্য ও প্রযুক্তিখাত রয়েছে। এর সঙ্গে সবুজ জ্বালানিতে বিনিয়োগ করবে বেইজিং। বর্তমানে বিশ্বের ৮০ শতাংশ সোলার প্যানেল চীন উৎপাদন করছে। বাংলাদেশে সোলার উৎপাদন কারখানায় বিনিয়োগ করবে। এ ছাড়া খাদ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা মাথায় রেখে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতে বিনিয়োগ করবে চীন। এর বাইরে টেক্সটাইলে বিনিয়োগ করবে বেইজিং। বর্তমানে টেক্সটাইলের সিংহভাগ চীন থেকে আমদানি করে বাংলাদেশ। চীনের প্রতিষ্ঠান এখানে টেক্সটাইলে বিনিয়োগ করলে বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা কমে আসবে।

তিস্তা প্রকল্পের অগ্রগতি জানতে চাইলে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে চীন। তবে এ প্রকল্প নিয়ে সরকারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। এর বেশি কিছু এ মুহূর্তে বলা যাবে না।

বাংলাদেশে চীনের অর্থায়নে প্রকল্পগুলো ধীরগতির কারণ জানতে চাইলে তার বিরোধীতা করেন ইয়াও ওয়েন। তিনি বলেন, এ মন্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। বরং চীনের প্রকল্পগুলো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিতে রয়েছে। ২০১৬ সালে ২৭ প্রকল্পের বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়েছিল। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে, এক তৃতীয়াংশ প্রকল্প বর্তমানে চলমান রয়েছে এবং এক তৃতীয়াংশ প্রকল্প আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশে কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প ধীর গতি হওয়ার অন্যমত কারণ হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণ।

২০২৬ স্বল্পন্নোত দেশের কাতার থেকে বের হয়ে গেলে চীনের ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল থাকবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পন্নোত দেশ থাক বা উন্নত দেশে পরিণত হোক। চীনের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বহাল থাকবে।