টেকসই সামাজিক পরিবর্তন এবং ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে লৈঙ্গিক সমতা রক্ষার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশগুলো– এমনকি উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহও ব্যর্থ হয়েছে সর্বক্ষেত্রে নারীর পর্যাপ্ত অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে। এ দেশে সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার, শ্রমশক্তিতে বৈষম্যহীন অংশীদারিত্ব ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার বেছে নেওয়াসহ বেশ কিছু বিষয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও সত্যিকার অর্থে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত সংস্কার করা হয়নি। তাই কর্মক্ষেত্রে এখনও নারীরা বৈষম্যের শিকার হওয়ার পাশাপাশি এমন অনেক প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা আমরা যত্ন নিয়ে ভাবছি না। তবে এসব সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু অগ্রগামী নীতির বাস্তবায়ন এবং  নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে যে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে ও সফল হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ (ইউবিএল) অন্যতম।

ইউনিলিভার ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানে নারী ব্যবস্থাপকদের আনুপাতিক হার বাড়াতে ‘৫০/৫০ বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা’ হাতে নেয়। এক দশকেরও কম সময়ের ব্যবধানে নারী নেতৃত্ব বাড়ানোর এ যাত্রায় ইউনিলিভার প্রতিষ্ঠানটিতে নারী ব্যবস্থাপকের আনুপাতিক হার ১০ থেকে ৪৪ শতাংশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। আরও আশাব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে– বর্তমানে ইউবিএলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব রয়েছে  ৫০ শতাংশ এবং এই সফলতার জন্য কোম্পানির সুনির্দিষ্ট ডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন (ডি অ্যান্ড আই) এজেন্ডা শক্তিশালী কৌশল হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।

কর্মক্ষেত্রে ইউনিলিভার তার প্রতিটি বিভাগে নারীর অবস্থান পর্যালোচনা ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং নারী অন্তর্ভুক্তির জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ হাতে নেয়। কাজের ধরনে পার্থক্যের কারণে কোম্পানির কিছু কিছু বিভাগে নারীর অংশগ্রহণ প্রথাগতভাবেই কম এবং ইউনিলিভার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সে সব ক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা বাড়াতে মনোযোগ দিয়ে আসছে। এ ব্যাপারে ইউবিএলের নেওয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে– ফ্যাক্টরি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নারীকে নিয়োগ এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করা, মাঠ পর্যায়ে বিক্রয় বিভাগে নারী নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া ইত্যাদি।

সম্মুখসারিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে তাদের জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রাত্রিকালীন শিফট চালু করেছে কোম্পানিটি। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এবং তাদের জন্য অনুকূল কর্মপরিবেশ তৈরিতে প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিক্রয় বিভাগকে নেতৃত্বদানে ‘ফিমেল রিজিওনাল ম্যানেজার’ নিয়োগ এবং তাদের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হয়েছে ইউনিলিভার। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধার অভাবে কর্মজীবী নারীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ভূমিজ ফাউন্ডেশন’-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ইউবিএল সারাদেশে নারীবান্ধব, সুরক্ষিত ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট-এর উন্নয়নে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউশন হাউসগুলোতে ৩৪টি নারীবান্ধব ওয়াশ সুবিধা তৈরি করেছে। এছাড়াও ইউবিএল ৫০টি নারীবান্ধব বিক্রয় এলাকা তৈরি করেছে, যেন আরও বেশি সংখ্যক নারী এই পেশায় আসতে উদ্বুদ্ধ হয়।

কর্মজীবী বাবা-মায়েদের জন্য সন্তানের যত্ন নিশ্চিত করতে ইউনিলিভার বাংলাদেশ তার করপোরেট অফিসে ‘অপারেশনাল ক্র্যাশ ফ্যাসিলিটি’ চালু করেছে। টঙ্গীর হোম কেয়ার ফ্যাক্টরির জন্যও কোম্পানির তৃতীয় পক্ষের মালিকানাধীন সম্পত্তিতে একই সুবিধা রয়েছে। ইউবিএল ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের কল্যাণার্থে ‘স্ট্রাইড’ প্রকল্প শুরু করে, যেটির আওতায় নারীরা প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ‘ক্যারিয়ার ব্রেক’ বা চাকরিতে কর্মবিরতি নিয়ে পুনরায় করপোরেট সেক্টরে ফিরতে পারছেন। 

ইউনিলিভার বাংলাদেশে কর্মরত নারীদের অনুপ্রাণিত করতে ও তাদের সাফল্য অর্জনে সহযোগিতার জন্য ইউবিএল গড়েছে “She4She” প্ল্যাটফর্ম। এই আঙিনায় ইউবিএলের নারীরা একই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি তাদের অভিজ্ঞতা ও ভাবনা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করার সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়া, দেশের সর্বত্র নারীর শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজনে পাশে থাকার জন্য ইউবিএল গড়েছে #StandStrong নামে আরেকটি প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশে নারীর জন্য কাজের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে ‘ইনস্পিরিট এক্সটার্নাল কাউন্সিল’ প্রোগ্রামের আওতায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শীর্ষ আটটি সংস্থা থেকে পরামর্শকদের নিয়ে আসারও উদ্যোগ নিয়েছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ।

ইউবিএলের উদ্দেশ্য কর্মীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠা। তাই তারা পারিবারিক সহিংসতা বা অমর্যাদার শিকার হলে ইউনিলিভার বাংলাদেশ তাদের জন্য চিকিৎসাসেবা এবং মানসিক সহায়তা ও পরামর্শের সুযোগ করে দিচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে কর্মীদের ১০ দিন পর্যন্ত সবেতন ছুটি দেওয়ার পাশাপাশি ওই সময়ে দেশে ইউনিলিভারের যেকোনো কার্যালয়ে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বক্ষেত্রে লৈঙ্গিক সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।

ইউনিলিভারের ব্র্যান্ডগুলোও নারীর ক্ষমতায়ন, তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও তাদের আরও আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিটারজেন্ট ব্র্যান্ড ‘রিন’– ‘রিন নামকরা নারী’ নামে একটি ক্যাম্পেইন শুরু করে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ব্র্যান্ডটি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা আত্মপরিচয় তৈরি করা নারীদের গল্প সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং অন্য নারীদের এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করছে। এছাড়া, অভিজাত ব্র্যান্ড ‘ডাভ’ তার সেলফ-ইস্টিম প্রজেক্ট (ডিএসইপি)-এর মাধ্যমে কিশোরীদের ইতিবাচক ভাবনায় বেড়ে ওঠা ও সত্যিকারের সৌন্দর্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৪২টি দেশের সাড়ে ৩ কোটি তরুণ-তরুণী ডাভ-এর এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। ত্বকের যত্নে দেশের ঘরে ঘরে পরিচিত ইউনিলিভারের ‘গ্লো অ্যান্ড লাভলী’ও কাজ করে যাচ্ছে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য।

ইউনিলিভার বাংলাদেশ নিজস্ব করপোরেট পরিমণ্ডল ও অন্যান্য সামাজিক প্রেক্ষাপটে এককভাবে এবং অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে নারীর কল্যাণে নিরবচ্ছিন্নভাবে অবদান রেখে চলেছে। পাশাপাশি ইউবিএলের আপসহীন নারী নেতৃত্ব পূর্ণ স্বাধীনতায় দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির এবং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।