- বাংলাদেশ
- ভোট শুরুর আগে মারামারি পুলিশের লাঠিপেটা
ভোট শুরুর আগে মারামারি পুলিশের লাঠিপেটা
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচন

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বুধবার পুলিশের সঙ্গে আইনজীবীদের ধস্তাধস্তি সমকাল
আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে। হৈচৈ, হট্টগোল, মারামারি ও ধাক্কাধাক্কির মধ্য দিয়ে গতকাল বুধবার প্রথম দিনের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত কমিটি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ধরে এই গন্ডগোলের সৃষ্টি হয়। বিকেলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বার ভবনে ভাঙচুর চালালে তাঁদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এক পর্যায়ে শতাধিক পুলিশ তাঁদের ওপর চড়াও হয়। এর আগে সকালে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। পরে তাঁদের বের করে দেওয়া হয়। এ সময় দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকদেরও বেদম লাঠিপেটা করে পুলিশ। এতে সাংবাদিক, আইনজীবীসহ কমপক্ষে ৩০ জন আহত হন। ব্যালট ছিনতাই ও হট্টগোলের অভিযোগে গতকাল রাতে ১১২ জনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়েছে।
এ কারণে নির্ধারিত সময় সকাল ১০টার পরিবর্তে আড়াই ঘণ্টা পর দুপুর সাড়ে ১২টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে শেষ হয় বিকেল ৫টায়। ৮ হাজার ৬০২ ভোটারের মধ্যে প্রথম দিনে ভোট পড়েছে ২ হাজার ১১৭ ভোট। আজ বৃহস্পতিবার শেষ দিনের ভোট নেওয়া হবে।
নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের দাবিতে দুই দিনব্যাপী নির্বাচনের প্রথম দিনেই বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের প্রতিবাদের মুখে ভোট গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। এ নিয়ে সারাদিন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী ভবন প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তাঁরা ভোটে অংশ না নিয়ে বিকেল ৩টায় প্রেস বিফিং করে নির্বাচন বন্ধের পাশাপাশি নতুন করে নির্বাচনী তপশিল ঘোষণার দাবি জানান। এরপর ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও ব্যারিস্টার রহুল কুদ্দুস কাজলের নেতৃত্বে মিছিল নিয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা নির্বাচনী প্যান্ডেলে থাকা চেয়ার-টেবিল ও টেবিল ফ্যান ভাঙচুর করেন। সুপ্রিম কোর্ট বারের নিচতলায় একাধিক চেম্বার ভাঙচুর করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপরই আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা স্লোগানসহ পাল্টা মিছিল করেন।
এদিকে, ভোটকেন্দ্রে বিক্ষোভ, সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান ও আইনজীবীদের ওপর লাঠিচার্জ ও মারধরের কারণে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ। এতে করে কমপক্ষে ১০ সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান ও আইনজীবীসহ ৩০ জন আহত হয়েছেন। একজন সাংবাদিককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পুলিশের লাঠিচার্জ ও হামলায় আহত হয়েছেন– এটিএন নিউজের রিপোর্টার জাবেদ আক্তার, বৈশাখী টিভির ক্যামেরাপারসন ইব্রাহিম হোসেন, এটিএন বাংলার ক্যামেরাপারসন হুমায়ুন কবির, সময় টিভির ক্যামেরাপারসন সোলাইমান স্বপন, ডিবিসি নিউজের ক্যামেরাপারসন মেহেদী হাসান মিম, জাগো নিউজের রিপোর্টার ফজলুল হক মৃধা, আজকের পত্রিকার রিপোর্টার এস এম নুর মোহাম্মদ, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির জান্নাতুল ফেরদাউস তানভীসহ কমপক্ষে ১০ সংবাদকর্মী। তাঁদের মারতে মারতে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়।
এটিএন নিউজের সাংবাদিক জাবেদ আক্তার সমকালকে বলেন, আমি দু’জন পুলিশকে অনুরোধ করেছি, আমি সাংবাদিক, নিউজ করার জন্য এখানে এসেছি। ওই সময় পুলিশ তাঁকে বুট দিয়ে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর কিল-ঘুসি মারে। এ ছাড়া আমাকে ফেলে দিয়ে কলার ধরে উঠিয়ে আবার নিচে ফেলে দেয় একাধিক পুলিশ।
সেসঙ্গে তাকে চড়থাপ্পড় মারে পুলিশ। বিকেল ৩টার দিকে ভোটে অংশ না নিয়ে বিএনপিপন্থি প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোট বন্ধের দাবি করেন। তিনি বলেন, এটি কোনো নির্বাচন নয়, তাই বর্জন নয়। ভোট গ্রহণ, আইনজীবী-সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় প্রধান বিচারপতির কাছে বিচার দাবি করেন এ আইনজীবী নেতা। এ সময় জয়নুল আবেদীন, এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা .বাদলসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার রাত থেকে সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। গতকাল সকাল ৭টা থেকে আইনজীবী সমিতির প্রাঙ্গণে কয়েক প্লাটুন পুলিশ দেখা যায়। এ ছাড়া সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। সকাল ৮টা থেকেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা সমিতি প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হন।
আগের দিন মঙ্গলবার রাতে ব্যালট পেপার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ছাড়া নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাবেক বিচারপতি মো. মুনসুরুল হক চৌধুরী হঠাৎ মঙ্গলবার রাতে ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করার পর সমিতির বিএনপি ও আওয়ামী সমর্থক নেতারা আলাদা দু’জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেন।
গতকাল সকালে আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা তাঁদের গঠন করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুজ্জামানের অধীনে সুপ্রিম কোর্ট বারে ভোট গ্রহণ শুরুর চেষ্টা করেন। এ সময় বাধা দেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তাঁরা দাবি জানান, সুষ্ঠু পদ্ধতির মাধ্যমে ভোট গ্রহণ শুরু করতে হবে। এতে দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ও হট্টগোল শুরু হয়। দু’পক্ষই পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে স্লোগান দেন। এ পর্যায়ে দু’পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি ও হট্টগোল হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। বিএনপিপন্থি প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকে লাঞ্ছিত করা হয়।
এবারের নির্বাচনে সাদা প্যানেল থেকে সভাপতি পদে মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির এবং সম্পাদক পদে আবদুন নুর দুলাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দু’জনই সুপ্রিম কোর্ট বারের বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক। অন্যদিকে নীল প্যানেল থেকে সভাপতি পদে ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এ প্যানেল থেকে সম্পাদক পদে প্রার্থী হন সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
১১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই ও হট্টগোলের ঘটনায় ১১২ আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
গতকাল রাতে রাজধানীর শাহবাগ থানায় করা মামলায় বিএনপিপন্থি আইনজীবী প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত আরও ১০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন উপকমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
প্রধান বিচারপতির দুঃখ প্রকাশ : সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের ওপর লাঠিচার্জ ও মারধরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত। দায়িত্ব পালনের সময় সবার সতর্ক হওয়া উচিত। এ সময় তিনি অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দেন।
গতকাল দুপুরে প্রধান বিচারপতির দপ্তরে ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের (এলআরএফ) সভাপতি আশুতোষ সরকার ও সাধারণ সম্পাদক আহাম্মেদ সরোয়ার হোসেন ভূঁঞার নেতৃত্বে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল অভিযোগ জানাতে গেলে এ আশ্বাস দেন তিনি। এ সময় প্রধান বিচারপতি হামলার ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিতে বললে সংগঠনের নেতারা বিকেলে তা জমা দেন।
বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা ও বিচার দাবি : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের সময় সাংবাদিকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন। এতে হামলার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি ও আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবি করেন নেতারা। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএফইউজে- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি), জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ অন্যান্য সংগঠন। এদিকে, সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে সাতদলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ। গতকাল এক বিবৃতিতে জোট নেতারা এ দাবি জানান।
মন্তব্য করুন