
নাগরিক সেবা প্রদানকারী সব সরকারি দপ্তরে কর্মচারীদের যেন একই রা– টাকা দিলেই কাজ করা হবে, নচেৎ না। তাঁরা নিজেরাই ‘কাজের রেট’ বেঁধে রেখেছেন। এর চেয়ে কম দিতে চাইলে তাঁরা ‘না’ বলে বিদায় করেন সেবাপ্রার্থীকে।
অতি সম্প্রতি ভূমি অফিসের নাম জারির কাজে যাওয়া এক ব্যক্তির কাছে চাওয়া হয় ২৫ হাজার টাকা। এর এক পয়সা কমে কাজটা করা যাবে না। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, ভাইরে, সবাইকে তো দিতে হবে! ব্যাপারটা তো আমার একার না। মানে, যেসব লোক বা যাঁরা ওই অফিসে কর্মরত, প্রত্যেকের পকেটেই ওই ‘প্রণোদনা’ যাবে। শুনে আগত লোকেরও মনে হলো, ঠিকই তো! সবাই মিলেই তো কাজটি করবেন। তাহলে সবাই তো ঘুষের ভাগ পাবেন। তাই মনে মনে ‘তথাস্তু’ বলে তিনি টাকা দিলেন। কর্মচারী আগেই বলেছেন, সময় লাগবে দুই-তিন সপ্তাহ। টাকা গুণে দেওয়ায় তা তরতরিয়ে হয়ে গেল ৭ দিনেই। যিনি ঘুষ দিয়ে কাজটি করালেন, তিনি মহাখুশি। কারণ বিনা ঘুষে তিনি তাঁরা ফাইলে একটি স্বাক্ষরও নিতে পারতেন না।
খাজনা দেওয়ার বিষয়ে একটি ছোটো তথ্য দিই। এখন তো প্রায় সবই অনলাইনে। ভূমি কর বা খাজনাও অ্যাপের মাধ্যমে দেওয়ার রীতি চালু হয়েছে। বলাও হলো, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অ্যাপে ঢুকে খাজনা দেওয়ার অপশনে গেলেই সব করতে পারবেন নিজেই; ঘরে বসে। অফিসেও আর আসতে হবে না। আপনি সেন্ড করলেই আমাদের এখানে আসবে। কথা সত্য।
মিথ্যাটা হচ্ছে– আপনি কোথায় কোন কথা সঠিক হবে, সেটা জানেন না। কোথায় টিক দেবেন বা কোথায় সঠিক কথাটি লিখবেন, তা যদি জানেন তাহলে ঘরে বসে তো সেই একটি মাত্র পাতা পূরণ করতে পারবেন। সেসব তো আপনি জানেন না। তখন পরামর্শ দেওয়া হলো, কম্পিউটার নিয়ে যাঁরা ব্যবসা করছেন তাঁদের কাছে যান। সামান্য খরচ করে খাজনা দিয়ে দেন। সেটাও ভালো পরামর্শ। কিন্তু এক পাতার ওই ফরমে তিনি কোন খাতে কী লিখতে হবে, সেই জ্ঞানটুকু দেন না। ফলে খাজনাদাতা তাঁকেই রিকোয়েস্ট করেন। তিনি রাজি হন। ১০ মিনিট পর তিনি এ কাজে ব্যয় করেন ৩ মিনিট। অনলাইনেই পেমেন্ট হলো। বিকাশ বা নগদ বা রকেট অথবা ওই রকম অনলাইন ব্যাংকিং অ্যাপের মাধ্যমে। তার ৩ মিনিটের মাশুল নিলেন দুইশ টাকা মাত্র।
তো এই পদ্ধতিতে কাজ এগোচ্ছে তরতরিয়ে। সরকার হ্যাপি। কেননা, তার তহবিলে টাকা জমছে। কর্মচারীরাও হ্যাপি। কেননা, তিনি ৩ মিনিটে বাড়তি দুইশ করে টাকা আয় করছেন। এই আয় কিন্তু তাঁর চাকরির বেতনের বাইরে। সরকারি বেতনের বাইরে তিনি সেবা বিক্রি করছেন এ কায়দায়। এ ধরনের ঘুষ আদায় এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। ঘুষের টাকা সবাই পান বা না পান; গ্রহণ করেন বা না করেন; টপ টু বটম– সবাই এই কারিশম্যাটিক বাণিজ্যের খবর জানেন।
এই বাণিজ্যের বেশিরভাগই টেবিলের নিচ দিয়ে হয়। কোথাও কোথাও ওপর দিয়েও হয়। আবার কোথাও ওপর বা নিচ নয়; মাঝামাঝি। টেবিলের ড্রয়ারটি অর্ধেক খোলা থাকে। সেখানে টাকার নোটগুলো দিলেই স্বাক্ষরকর্তা কলম চালান। এই দৃশ্য আমি নিজে দেখেছি। শুনেছি, এ ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারী যখন বাসায় ফেরেন, তাঁরা পকেটভর্তি থাকে টাকা।
এমন অভিজ্ঞতা হয়তো আরও আছে। যাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হয়; বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নথিপত্র পার করিয়ে আনতে হয়; তাঁদের অভিজ্ঞতা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। আর সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা বিভিন্ন বিট করেন, তাঁদের কাছে পাওয়া যায় আরও নানা রোমহর্ষক খবর।
এই যে খাদ্যপণ্য সিন্ডিকেট, তা ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রায়ই ভোক্তা-ক্রেতাদের আকুতি ওঠে। তারপরও বাড়তেই থাকে পণ্যের দাম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নজরদারি কেন কাজে দেয় না? আমদানিকারক বা মজুতদারদের কাছে গেলে জানা যায়, তাঁরা সরকারি কর্মচারীদের ‘উপহার’ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ‘চাঁদা’ দিয়েই নিশ্চিন্তে বাণিজ্য চালিয়ে যান। ওদিকে সরকার দর ঠিক করে দেওয়ার পরও বাণিজ্যমন্ত্রীকে বলতে হয়, কিছু আমদানিকারক সেই দরে পণ্য বিক্রি করছেন না। তাঁদের কারণেই বাজার অস্থিতিশীল। তিনি চেনেন তাঁদের, কিন্তু ধরতে পারেন না।
আমাদের দেশে ঘুষের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে। যেসব কর্মকর্তা ঘুষ খান, তাঁদের দেহের চর্বি দেখেই নাকি টের পাওয়া যায়। আর যাঁরা ঘুষ খান না, তাঁদের বলা হয় ‘বোকা’। এককালে আমার বন্ধু ছিলেন পুলিশের একজন বড়কর্তা। অনেক বছর পর তাঁর দপ্তরে গিয়ে দেখি, শরীর এখনও পাতলা; চর্বি জমেনি। বললাম, কী ব্যাপার! এখনও ‘মেদাসক্ত’ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি? আমাদের আরেক সহপাঠীর প্রসঙ্গ উঠল। তিনি প্রশাসনের বড় কর্তা। ছাত্রজীবনে পাতলা লিকলিকে ছিলেন; এখন বিশাল ভুঁড়ির অধিকারী। স্বীকার করতে হবে, ভুঁড়ির সঙ্গে ঘুষের বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু সমাজে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর যা কিছু রটে, তা কিছু না কিছু ঘটে তো বটেই।
ঘুষ না খাক; প্রশাসন বা পুলিশের কর্তারা কিংবা যে কোনো সরকারি দপ্তরের কর্মচারী সেবাপ্রার্থীকে যে দেহভাষা প্রদর্শন করেন; যে ভাষা মুখে ব্যবহার করেন, তা উপমহাদেশের বাইরে আর কোনো দেশে দেখা যাবে না। আমি নাতিদীর্ঘকাল যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেছি। সেখানে সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে পুলিশ বা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমন ব্যবহার কল্পনাই করা যায় না।
পুলিশ ও প্রশাসনের ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ ভাবমূর্তি এসেছে ঔপনিবেশিক যুগ থেকে। তা না হলে জনসাধারণকে ‘শাসন’ করবেন কেমন করে? এই মনোলগ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনেও কালচারাল হেরিটেজে পরিণত হয়েছে। দেশটি উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছে বটে; সেই উত্তরাধিকারই বহন করছি চিন্তা-ভাবনা, কাজ-কর্ম, কর্তব্য পালনে। এর বাইরে তো কিছু চিন্তা করতে পারি না আমরা। আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে এই অন্ধ অনুকারী কূপ থেকে। না হলে আমাদের স্বাধীনতা পরাধীনতার আঁধারেই থেকে যাবে।
ড. মাহবুব হাসান: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মন্তব্য করুন