সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচন ঘিরে কম ঘোলা হয়নি জল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত সংঘাতে গড়ায়। ভাঙচুর, ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি সবই চলে। সামাল দিতে গিয়ে চড়াও হয় পুলিশও। লাঠিপেটায় আহত হন সাংবাদিকসহ অনেকে। মামলা গড়িয়েছে আদালতে। ভোট শেষে নিরঙ্কুশ জয় পায় আওয়ামী লীগপন্থি প্যানেল। পেশাজীবী এ নির্বাচনে কেন এবার উত্তেজনার পারদ এতটা চড়ল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক দুই সভাপতির কাছে কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে  সমকাল


সমকাল : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? আপনারা মনোনয়নপত্র দাখিল করলেন, নির্বাচন বর্জন করলেন না। তবে কেন ভোটদান থেকে বিরত থাকলেন?

জয়নুল আবেদীন : ভোটদান থেকে বিরত থাকিনি, আমরা দু’পক্ষ মিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঠিক করলাম সাবেক বিচারপতি মো. মুনসুরুল হক চৌধুরীকে। তিনি কিন্তু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য। আমরা চেয়েছি, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। তিনি প্রজেকশন মিটিং খুব ভালোভাবেই করলেন। তারপর তিনি রুমে গেলেন। এক ঘণ্টা পর শুনলাম, তিনি পদত্যাগ করেছেন। আমরা ধরেই নিলাম, সরকারের বড় একটি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। পরদিন আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে গেলাম। তাঁকে বললাম, আমরা সবাই মিলে অনুরোধ করলে হয়তো তিনি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করবেন। কিন্তু সেখানে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদক প্রার্থী এলেন না। দুই ঘণ্টা অ্যাটর্নি জেনারেলের রুমে বসে থেকে আমরা চলে এলাম। এরপর বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের কাছে গেলাম। তাঁকে পদক্ষেপ নিতে বললাম।

তিনিও চেষ্টা করলেন, তাঁদের ডাকলেন, তবে তাঁরা এলেন না। তখন আমরা চলে এলাম। পরে শুনলাম নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মনিরুজ্জামানকে একতরফাভাবে আহ্বায়ক করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করেছে। সারাদিন এ নিয়ে নাটক চলল। এরপর রাতে শুনলাম আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা একটা রুমের মধ্যে বসে মনিরুজ্জামানের উপস্থিতিতে ব্যালট বাক্স ভরার জন্য সিল মারছেন। আমাদের লোকজন গিয়ে সেখানে বাধা দিলেন। আমরা বললাম, নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। যৌথভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হবে। কিন্তু আপনারা এটা কী করছেন? যার ভোট সে দেবে, আগ থেকে কেন সিল মারা হবে। দেখা গেল তারা সেটা মানল না। তারা কোনো ব্যালট বাক্স দেখাতে চাইল না। আমাদের প্রার্থীরা বললেন, আমাদের অন্তত ব্যালট বাক্স দেখান। আগে থেকে কেন ব্যালট বাক্সে ভোট ভরে রাখছেন। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। আপনারাও দেখলেন, পুরো জাতি দেখল। এই নির্বাচনে সাধারণ আইনজীবীরাও ভোট দেননি। নির্বাচনের দিন সকালে আমাদের এজেন্টদের জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে।

সমকাল : আপনাদের অনুপস্থিতিতেই নির্বাচন হয়ে গেল, ফল ঘোষণা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জয় লাভ করল। এরপর আপনারা কী পদক্ষেপ নেবেন?  

জয়নুল আবেদীন : আমরা একতরফা নির্বাচন বাতিল চাইছি। প্রধান বিচারপতিকে আমরা বলেছি, একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন হোক। এটা হলে সুষ্ঠু ভোট হবে। আমরা প্রধান বিচারপতির কাছে নির্বাচন বাতিল দাবি করছি। তিনি সাংবিধানিকভাবে আমাদের অভিভাবক। তাঁকে অনুরোধ করেছি। আশা করি, সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসবেন তিনি। এ ছাড়া আমাদের জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে  সব জেলা আইনজীবী সমিতিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হবে।

সমকাল : প্রধান বিচারপতির বরাত দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটা প্রাইভেট সংগঠন। এখানে তাঁর কিছু করার নেই।

জয়নুল আবেদীন : এটা প্রাইভেট বডি নয়, এটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের জায়গা। প্রধান বিচারপতি তো আমাদের সাংবিধানিকভাবে অভিভাবক। এর দায়িত্ব তাঁরই। তিনি এটার সমাধান দিতে পারেন।

সমকাল : নির্বাচনে বিএনপিপন্থিদের সভাপতি প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ অন্য আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুরসহ হট্টগোলের অভিযোগে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়েছে। এগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবেন?

জয়নুল আবেদীন : এগুলো সরকারের ক্ষমতা। তাদের ক্ষমতা আছে, করেছে। আমরা হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়েছি। মামলা আইনিভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এটা একটা ভিত্তিহীন মামলা। প্রধান বিচারপতির কাছে বলা ছাড়া আমাদের কোনো আইনি পদক্ষেপ নেই। এই সরকার পুলিশ দিয়ে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের মারছে। পুলিশ পাহারায় ভোট করেছে। ফলে এই সরকার যতদিন আছে, ততদিন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে আমি মনে করি না।  দিনের ভোট যখন রাতে হয়ে যায়, সেখানে সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোট তো কোনো বিষয়ই নয়। এটা তো সর্বোচ্চ আদালতের জায়গা। এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না, এটা তারা আরেকবার প্রমাণ করল।

সমকাল : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। এ নির্বাচনের কারণে এই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হলো কিনা?

জয়নুল আবেদীন : আমি জীবনে বহু নির্বাচন দেখেছি এবং করেছি; কিন্তু এমন নির্বাচন আমার জীবনে দেখি নাই। একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ছাড়া ভোট করে এই সরকার প্রমাণ করল– আমরা সবই পারি। পুলিশ দিয়ে শতাধিক আইনজীবীকে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। এতে সুপ্রিম কোর্ট ও আইনজীবী সমিতিকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদের লাঠিপেটা করা হয়েছে। এর পর আইনজীবীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দেওয়া হয়েছে।

সমকাল : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে এক সময় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, শামসুল হক চৌধুরীসহ  প্রখ্যাত আইনজীবীরা নেতৃত্বে ছিলেন। নির্বাচন ঘিরে যে অনাকাঙ্কিত ঘটনা ঘটল, তাতে কি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে কিনা?

জয়নুল আবেদীন : শুধু সুপ্রিম কোর্ট বারের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও আইনজীবীদের মর্যাদাও ক্ষুণ্ন হয়েছে। সেটা হয়েছে এই সরকারের কারণে। এটা তো সর্বোচ্চ আদালতের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা নিজেরাই নষ্ট করেছে। কমিশন ছাড়া যে প্রতিষ্ঠানে ভোট হয়, সেই প্রতিষ্ঠানে যাঁরা আজ জোর করে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের আর মানুষ সম্মান করবে না।
সমকাল : এই অস্থিরতা দূর করার উপায় কী?

জয়নুল আবেদীন : একমাত্র পথই হচ্ছে এই সরকারের বিদায় হওয়া। এ ছাড়া কেউ দেশে শান্তিতে কাজ করতে পারবে না। এখন যে দেশে দিনের ভোট রাতে হয়, সেই দেশে আর ভালো কী হবে। তার প্রমাণ আবারও আপনারা দেখলেন। আগামী নির্বাচনে কী হবে, সেটা তো এখনই বোঝা যাচ্ছে।

সমকাল : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

জয়নুল আবেদীন : আপনাকেও ধন্যবাদ।