
বরগুনায় ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য খোলা জাহাজে কয়লা পরিবহন করা হচ্ছে। এতে পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদী দূষণের শিকার। পরিবেশবাদীদের দাবি, দূষণের কারণে দেশের ইলিশের অন্যতম অভয়াশ্রম হুমকিতে পড়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী টেংরাগিরি সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বনের জীববৈচিত্র্যও নষ্ট হচ্ছে।
জানা গেছে, বরগুনার তালতলীতে চায়না রিসোর্স নির্মিত ৩০৭ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গত ১ জানুয়ারি চালু হয়। এ প্রকল্পের ৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক থাকলেও দেশীয় প্রতিষ্ঠান আইসোটেকের এখন কোনো হদিস মিলছে না। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্য এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না থেকে ৩৪ কোটি ৭৪ লাখ ৭২ হাজার মার্কিন ডলার, ব্যাংক অব চায়না লিমিটেড (সিঙ্গাপুর শাখা) থেকে ৫ কোটি ১৭ হাজার ৫০০ ডলার ও ব্যাংক অব চায়না লিমিটেড (বেইজিং শাখা) থেকে ৩ কোটি ১০ হাজার ৫০০ ইউএসডি ঋণ নেওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের এপ্রিলে কেন্দ্রটি থেকে ২৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চুক্তির সময় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ধরা হয় ৬ দশমিক ৭৭ টাকা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বেশি হওয়ায় বিদ্যুতের দামও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গত জানুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ প্রায় ১ হাজার ২৪ কোটি টাকার কর মওকুফ করে সরকার।
সূত্র জানায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য খোলা বার্জে কয়লা আনা হচ্ছে । গত ১১ মার্চ এ ধরনের ৮টি বার্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে নোঙর করে। পরিবেশবাদীদের দাবি, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশের সংরক্ষিত ও দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন টেংরাগিরি থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে। বরগুনার পাথরঘাটার সংরক্ষিত লালদিয়া বন থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। এ জন্য কয়লাচালিত কেন্দ্রটি এই দুই বনের অপূরণীয় ক্ষতি করবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল সমকালকে বলেন, ‘জাহাজ থেকে কয়লা পড়ে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। কারণ এসব কয়লায় সালফারসহ ক্ষতিকারক পদার্থ রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে পথে তালতলীর কেন্দ্রে কয়লা আনা হচ্ছে, তা তিন নদীর মোহনা এবং দেশের ইলিশের অন্যতম অভয়াশ্রম। পাশেই টেংরাগিরি বন। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে এমনিতেই এলাকার জীববৈচিত্র্য ঝুঁকিতে। এখন কয়লায়ও খোলা বার্জে আনা হলে দূষণ কয়েক গুণ বাড়বে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য কয়লা ঢেকে রাখা জাহাজে পরিবহন করার কথা। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা ঢেকে আনা হয়। বরগুনার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সময় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পের বাংলাদেশি অংশীদার আইসোটেক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনুল আলম সমকালকে বলেন, ‘কয়লা জাহাজে ঢেকে আনা হবে– এ ধরনের কথা হয়েছে। সেটি হলে তো দূষণের শঙ্কা নেই।’
কিন্তু এখন বাস্তবে উল্টো ঘটছে। জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন সমকালকে জানান, কয়লা তো ঢেকে পরিবহন করার কথা। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।
জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি : তালতলী উপজেলার ৪১ নম্বর ছোট নিশানবাড়িয়া মৌজার খোট্টারচর এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হয়েছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয় ৩১০ একর। এ জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি হয়েছে বলে ২০২২ সালের ১১ মে প্রতিবেদন দেয় টিআইবি। সংস্থাটি জানায়, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৮১ একর ভূমির প্রয়োজন হলেও, অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৩১০ একর। এতে ১৫ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করে টিআইবি।
এ ছাড়া জোর করে ও ভূমি মামলার মাধ্যমে হয়রানি করে অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলেও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। তাঁরা প্রতিকার চেয়ে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন।
দেশি অংশীদারের খোঁজ নেই : চায়না রিসোর্সের সঙ্গে এ প্রকল্পে ৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিল দেশীয় প্রতিষ্ঠান আইসোটেক। কিন্তু বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি এ প্রকল্পের সঙ্গে নেই। তাদের কোনো খোঁজও মিলছে না। আইসোটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনুল আলমসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর বন্ধ। তাঁদের বনানীর অফিসও বন্ধ পাওয়া গেছে।
পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, আইসোটেকের কোনো হদিস নেই। প্রকল্পটি এখন পুরো চীনা কোম্পানির মালিকানায়। প্রকল্পে কাজ করেছেন এমন একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্মীদের কয়েক মাসের বেতন বকেয়া রেখে উধাও হয়ে গেছে আইসোটেক।
মন্তব্য করুন