দফায় দফায় ঘোষণা দিয়েও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কার্যক্রম শেষ করতে পারছে না সরকার। স্বাধীনতার পর ষষ্ঠ দফায় ২০১৪ সালে তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ওই বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অনলাইনে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির দাবিদার প্রায় দেড় লাখ ব্যক্তির আবেদন গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি আবেদনকারীদের যাচাই-বাছাই শুরু হয় সারাদেশে। তা এখনও চলছে। ৪০টি উপজেলা থেকে এর প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি।

২০২১ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে যে ৫ দফা বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, সেই তালিকার গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য যাচাই করে আংশিক (প্রথম দফা) তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। নামকরণ হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধার সমন্বিত তালিকা। গত দুই বছরে সমন্বিত তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও এর কার্যক্রম চলছে। 

বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকারকে বলব এবার ক্ষান্ত দিন। অনেক হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা শ্রদ্ধার পাত্র।

তাদের টানাহ্যাঁচড়া করে আর অপমান করবেন না। সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পর থেকে বারবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হচ্ছে। পরিচিত অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন তাঁরা কখনও স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেননি। পৃথিবীর আর কোনো দেশে কী স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হচ্ছে? যাঁরা চেয়েছেন তাঁরা ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। এবার থামা উচিত।’

এদিকে গত কয়েক বছর ধরে ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর সামনে রেখে মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে চলেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি এও বলেছেন, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর আর কারও স্বীকৃতির গেজেট প্রকাশ করা হবে না।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আকম মোজাম্মেল হক ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। টানা দুই মেয়াদে দায়িত্বে থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগামী ডিসেম্বরে সরকারের চলতি মেয়াদ শেষ হবে। এরমধ্যে চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কাজ শেষ হবে কি–না, এমন প্রশ্নই এখন বিভিন্ন মহলে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সরকারের এ মেয়াদেই বীর মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ সমাপ্ত হবে। সিলগালা করে দিয়ে যাব। পরবর্তী সরকার সেটা যেই হোক তারা যদি আবার তালিকাভুক্তি শুরু করে সেটি তখনকার বিষয়।’ 

স্বীকৃতির মানদণ্ড: চার ধরনের তথ্যের ভিত্তিতে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে মুক্তিবার্তা, লাল মুক্তিবার্তা ও ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়া হিসেবে যাঁদের নাম তালিকায় আছে এবং যাঁদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ মেয়াদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্র রয়েছে, তাঁরা সনদ পাচ্ছেন। এ ছাড়া ২০১৪ সালে অনলাইনে  যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছেন, তাঁদের তথ্যসহ নিজ নিজ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে যাচাই-বাছাই করে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য ২০১৬ সালে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা এবং ২০১৮ সালের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নির্দেশিকা জারি করা হয়।

বর্তমান অবস্থা: সমন্বিত তালিকায় থাকা  (চূড়ান্ত তালিকা) গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩৩৫। এ ছাড়া খেতাবপ্রাপ্ত, শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ১০ হাজার ৯৯৬ জন। জামুকার বিভিন্ন শাখার তথ্যানুযায়ী, ২০১৩-১৪ সালে অনলাইন ও সরাসরি মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার আবেদন জমা পড়ে। মামলা ও অন্যান্য কারণে ৪০টি উপজেলার আবেদন এখনও যাচাই-বাছাই বাকি। ৩৬টি উপজেলার যাচাই-বাছাই প্রতিবেদন পুনঃযাচাই বাকি। এসব প্রতিবেদন পাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন শেষ হতে পারে। এ ছাড়া বীরাঙ্গনা, প্রবাসী সংগঠক, শব্দসৈনিক, বিভিন্ন বাহিনীর বেসামরিক ব্যক্তিদের যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে জামুকার তত্ত্বাবধায়নে। এ পর্যন্ত ৪৭৩ জন বীরাঙ্গনা, ১৭ জন প্রবাসী সংগঠক, ২৯৬ জন শব্দসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।

এখন ষষ্ঠ দফা: বিভিন্ন সরকারের আমলে পাঁচবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটি ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম পাঁচটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ করে। ওই তালিকার গেজেট করা হয়নি। ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের করা তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৮৯২। ১৯৯৪ সালে বিএনপির আমলে করা তৃতীয় তালিকায় ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে চতুর্থ তালিকায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জনের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ষষ্ঠ দফা তালিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়।

তালিকা অসম্পূর্ণ: স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালে প্রথম নরসিংদীর আজিজুল হক ভূঁইয়াকে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্য শাখা স্টিয়ারিং কমিটির সভাপতি ছিলেন। এখন পর্যন্ত ১৭ জনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শাহরিয়ার কবির সমকালকে বলেন, ‘স্থপতি এফ আর খান, অধ্যাপক এনায়েতুর রহিম, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ আরও অনেকেই বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁদেরও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যক্তির ভূমিকাকেই প্রাধান্য দিয়ে স্বীকৃতি দিতে হবে।’

অন্যদিকে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ১০৮ জন কর্মীকে প্রথম শব্দসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পেয়েছেন ২৯৬ জন।  স্বীকৃতির বাইরে আছেন কমপক্ষে ১২৫ জন। তবে শব্দসৈনিকের স্বীকৃতি প্রদান বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।

স্বাধীন বাংলা বেতারকর্মী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন খান সমকালকে বলেন, ১৯৭১ সালে প্রায় ৪০০ বেতারকর্মী পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। সবার স্বীকৃতি না হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

তাঁরাও শহীদ বুদ্ধিজীবী: গত দুই বছরে ৩৩৫ শহীদ বুদ্ধিজীবীকে গেজেটের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। স্বীকৃতির বাইরে রয়েছেন হাজারও শহীদ বুদ্ধিজীবী। যাঁদের নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে, সেই পরিবারগুলোকে কোনো রাষ্ট্রীয় সহায়তা দেওয়া হয়নি। নির্ধারিত হয়নি তাঁদের মর্যাদাক্রমও। যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ও সাব-কমিটির সদস্য চৌধুরী শহীদ কাদের সমকালকে বলেন, ‘এক হাজারের বেশি আবেদন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁদের কাছে জমা হয়েছে। এখান থেকে প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত হওয়া তালিকা জাতীয় কমিটিতে পাঠানো হবে।’

রাজাকারের তালিকা: ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারসহ মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা প্রকাশ করে সরকার। চার দিন পর ভুলে ভরা ওই তালিকা ব্যাপক সমালোচনার মুখে প্রত্যাহার করা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তিতে তখন বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে এ তালিকা প্রকাশের প্রচেষ্টা থাকবে। কিন্তু ৩৯ মাস পার হলেও তালিকা প্রণয়নের কাজই শুরু হয়নি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সমকালকে বলেন, আগামী বছরের মার্চে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা হতে পারে।