ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

নোনা জলের কষ্ট-১

প্রতি ফোঁটা পানিই কেনা খেতে হয় মেপে মেপে

প্রতি ফোঁটা পানিই কেনা খেতে হয় মেপে মেপে

জাহিদুর রহমান, খুলনা থেকে ফিরে

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৩ | ২০:২২

খুলনার দাকোপের চালনা পৌর এলাকার বাসিন্দা আজিজুল হকের পরিবারে ছয় সদস্য। তাঁর এলাকায় কোনো নলকূপেই পানি ওঠে না। পুকুরগুলোতেও নোনা পানি। শুষ্ক মৌসুমে তাও মিলছে না। জরুরি কাজের জন্য প্রতিদিন ২০ লিটার পানি কেনেন তিনি। এলাকার এক ব্যবসায়ী পুকুরের পানি পরিশোধন করে লিটারপ্রতি ১ টাকায় বিক্রি করেন। আবার গরমের সময় পানির দাম বেড়ে হয় ২ টাকা। তিনি বলেন, প্রতি ফোঁটা পানি মেপে খেতে হয়। অনেক সময় তেষ্টা থেকেই যায়।

শুধু আজিজুল হক নন, দক্ষিণাঞ্চলজুড়েই পানির কমবেশি এ রকম কষ্ট। যাঁদের সাধ্য আছে, তাঁরা পানি কিনতে বা দূর-দূরান্ত থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষকে অনিরাপদ নানা উৎস থেকেই পানীয় জল সংগ্রহ করতে হয়।

খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও এর আশপাশের অঞ্চলে গভীর নলকূপ থেকে আর পানি উঠছে না। সুপেয় পানির অন্য উৎসগুলোয় লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় নলকূপের গভীরতা ৭০০ থেকে ১ হাজার ২০০ ফুটের মধ্যে হয়ে থাকে। স্থানীয়রা জানান, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১ হাজার ২০০ ফুট গভীর নলকূপ থেকেও তাঁরা আর পানি তুলতে পারছেন না। যে কারণে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। খাবার পানির জন্য তাঁদের দূর-দূরান্তের জলাশয়ের দিকে ছুটতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আজ বুধবার (২২ মার্চ) পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে প্রয়োজন ত্বরান্বিত উদ্যোগ’।

খুলনার পাইকগাছা ‘লোনাপানি গবেষণা কেন্দ্রে’র শতাধিক পুকুরের মধ্যে একটিতে মিলছে মিঠা পানি। আর সেই পুকুর ঘিরে আশপাশের নারী-পুরুষ কলসি ও ড্রাম নিয়ে হেঁটে কিংবা ভ্যান নিয়ে ছুটছেন। কেউ কেউ আবার ট্যাঙ্ক ভর্তি করে এ পানি নিয়ে যাচ্ছেন বিক্রি করতে। রান্না ও খাবারের জন্য এই পুকুরের পানিই তাঁদের ভরসা।

১০ কিলোমিটার দূরের গড়ইখালী থেকে লোনাপানি গবেষণা কেন্দ্রের পুকুরে পানি নিতে এসেছেন চম্পা রানী শীল। পানি নিয়ে দিনে দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন তিনি। এখন বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জেও একজন দিনমজুরের মজুরি দিনে কমপক্ষে ৫০০ টাকা। আট ঘণ্টা শ্রম দিলে ৫০০ টাকা যদি পাওয়া যায়, তবে প্রতি ঘণ্টায় ৬২.৫ টাকা। আর দুই ঘণ্টায় ১২৫ টাকা। এ পুকুর থেকে দিনে ৩০ লিটার পানি নেন চম্পা। এ হিসাবে ৩০ লিটার পানির জন্য এই নারীর ব্যয় ১২৫ টাকা।

এর উল্টো চিত্র রাজধানীতে। ঢাকা ওয়াসা এলাকায় থাকা একটি পরিবারকে এক হাজার লিটার পানির জন্য দিতে হয় ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। অথচ চম্পা শীলের মতো দক্ষিণাঞ্চলের আর্থিকভাবে নিম্ন আয়ের মানুষকে ৩০ লিটার পানির জন্য দিতে হয় ১২৫ টাকা। তাও কোনো রকম বিশুদ্ধকরণ ছাড়াই এ পুকুরের পানি পান করেন তাঁরা।

পাইকগাছার গদাইপুর থেকে পলি রানী দাস দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন দুপুরের পর লোনাপানি গবেষণা কেন্দ্রে ছোটেন পানির জন্য। বছর পাঁচেক আগেও বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের ভেতরে পানি পাওয়া গেলেও এখন পানির সেই উৎসগুলো শুকিয়ে গেছে। প্রায় চার কিলোমিটার হেঁটে পাইকগাছা লোনাপানি গবেষণা কেন্দ্রের পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করেন তিনি।

তবে পানি আনা-নেওয়ার পথে নারীদের কম ঝক্কি পোহাতে হয় না। সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) চলতি মার্চ মাসে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানীয় জলের অভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যার মধ্যে প্রতিবেশীর মাধ্যমে খারাপ ব্যবহার (মোংলা অঞ্চলে ৫৭.৮ শতাংশ ও শ্যামনগর অঞ্চলে ৭৬ শতাংশ), যৌন হয়রানি (উভয় এলাকায় ১০ শতাংশ), শারীরিকভাবে আহত হওয়া (দুই উপজেলায়ই ৭০ শতাংশের সামান্য কম) উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ সময় ধরে লবণাক্ততার সংস্পর্শে আছেন বা ছিলেন এমন নারীর প্রায় সবাই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন বলে উঠে এসেছে। এ নারীর মধ্যে একটি বড় অংশ প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন (৬৪ শতাংশ মোংলায় ও ৫৪ শতাংশ শ্যামনগরে) এবং এরই মধ্যে অনেকেই তাঁদের জরায়ু, গর্ভাশয় ও গর্ভনালির মতো প্রজনন অঙ্গ অপসারণ করতে বাধ্য হয়েছেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পানির সমস্যা, স্যানিটেশনের সমস্যায় (টয়লেট, স্যানিটারি ন্যাপকিন) ভুগে থাকেন মোংলায় ৪১ শতাংশ নারী, শ্যামনগরে ৩১ শতাংশ নারী এবং এর ফলে অনেক নারী আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতরে মাসিক ঋতু চক্রের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জটিলতায়ও ভুগেছেন।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর এলাকার বাসিন্দা ভবেষ চন্দ্র দাশ প্রতিমাসে তিন হাজার টাকার পানি কিনে থাকেন। তিনি বলেন, রান্নাবান্নার পানি অনেক দূর থেকে আনা লাগে। বাসায় নলকূপ বসিয়েছি; কিন্তু পানি ওঠে না। কখনও ভাবিনি পানিও কিনতে হবে। বাড়ির কাছেই ছিল বড় বড় পুকুর। কিন্তু লবণ পানি ঢুকে সব নষ্ট হয়ে গেছে।

শ্যামনগর শহরের নাকিপুর এলাকায় মৌসুমী ড্রিংকিং ওয়াটার প্লান্ট নামে পানির ব্যবসা খুলেছেন শাহীনুর রহমান। এতে ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি। ঘণ্টায় এক হাজার লিটার পানি বিশুদ্ধ করা যায়। প্রতি লিটার পানি বিক্রি করেন ২ টাকায়।

ওয়াটারএইড গবেষণা চালিয়ে দেখিয়েছে, চালনায় সুপেয় পানির জন্য ব্যয় রাজধানী ঢাকার তুলনায় ৩৮০ গুণ। গবেষণায় পানির দামের সঙ্গে পরিবহন খরচ, পানি পেতে ব্যয় হওয়া কর্মঘণ্টার হিসাব যুক্ত করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, পাইকগাছায় লিটারপ্রতি পানির দাম দেড় টাকা, কলারোয়ায় ২ টাকা ২৫ পয়সা আর কয়রায় আড়াই টাকা। ছয় সদস্যের একটি পরিবারে মাসিক পানির ব্যয় হবে তাঁদের আয়ের প্রায় ১৬ শতাংশ। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দলিলে বলা হয়েছে, এ খাতে পরিবার পিছু ব্যয় কখনোই আয়ের ৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের তৈরি জয়েন্ট মনিটরিং (জেএমপি ২০২১) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মৌলিক পানি সরবরাহের সুবিধা পায় ৯৮ শতাংশ মানুষ, আর নিরাপদ পানি পায় প্রায় ৫৯ শতাংশ। কিন্তু খুলনায় মৌলিক পানি প্রাপ্তির হার ৬৮ শতাংশ, সাতক্ষীরায় প্রায় ৬২ শতাংশ।

ওয়াটারএইডের কারিগরি সহায়তায় ২০১৪ সালে পাইকগাছা পৌরসভায় দুই লাখ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে ২ হাজার ৪৪৫টি পরিবার নিরাপদ পানির সুবিধা পাচ্ছে, যা মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ। এখানে ক্যাটাগরিভিত্তিক প্রতি এক হাজার লিটারের জন্য পৌরসভাকে ৬০ টাকা থেকে দেড়শ টাকা দিতে হচ্ছে। ওয়াটারএইড এ উপজেলায় ২৫৯টি পরিবারভিত্তিক রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করেছে। এ ছাড়া সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রেইন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরি করেছে। সরবরাহকৃত পানির মান বাড়াতে স্থাপন করা হয়েছে চারটি আয়রন রিমুভাল প্লান্ট।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় পানির যে সমস্যা, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এ সমস্যা সমাধানে এবং বৈষম্য নিরসনে আমরা কাজ করছি। সুপেয় পানির প্রাপ্যতা সহজ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও রিভার্স ওসমোসিসসহ সব কার্যকর প্রযুক্তি অনুসরণ করা হবে।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×