গাজীপুর সদর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইয়েদুল হক মোল্লা। ১৯৭১ সালের ভারতীয় তালিকায় (মেঘনা) ৪৮৫ নম্বরে নাম রয়েছে তাঁর। তিনি ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন’– ২০২১ সালে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) এমন অভিযোগ করেন স্থানীয় পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা। তদন্তের পর তখনই সাইয়েদুলের ভাতা বন্ধ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। শুনানিতে সাক্ষ্য দিতে চিঠি দেওয়া হয় অভিযোগকারীদের। হাজির থাকতে বলা হয়েছিল অভিযুক্তকেও। কিন্তু অভিযোগকারীরা হাজির হননি। প্রায় দুই বছর পর তদন্তে প্রমাণ হয়েছে ‘সাইয়েদুল হক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা’।
গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জের সিরাজুল হক মোড়ল ২০০৫ সালের ২৯ মে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হন। তাঁর বিরুদ্ধে জামুকায় অভিযোগ দেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম। শুনানির পর সিরাজুলের গেজেট ও লাল মুক্তিবার্তার স্বীকৃতি বাতিল করা হয়। কিন্তু পরে স্থানীয় চার মুক্তিযোদ্ধা নথিপত্রসহ সিরাজুলের স্বীকৃতি পুনর্বহালের জন্য আবেদন করেন। দুই বছর পর পুনঃশুনানি শেষে গত ১৭ জানুয়ারি সিরাজুলের মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও লাল মুক্তিবার্তার স্বীকৃতি পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সমকালের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এমন ঘটনা শুধু সাইয়েদুল বা সিরাজুলের নয়, ‘কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা’ আর ‘কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন’– এমন দ্বন্দ্বে হয়রানির শিকার হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের করা অভিযোগের কারণে বর্তমানে ২৮৮ জনের ভাতা বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব ও ব্যক্তিগত বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতি মাসেই অভিযোগ আসছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকায়। এর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির দাবিদার এবং মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল হয়েছে– এমন অগণিত ব্যক্তির পদচারণায় মুখর থাকছে সরকারি এ দুই প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে ২০১৭ সালে করা প্রায় দেড় লাখ ব্যক্তির আবেদন যাচাই-বাছাই নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, ১৪ হাজার ২১৩ জন ব্যক্তি প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা কিনা তা নিয়ে বিভক্তি রয়েছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। আবার কিছু ব্যক্তিকে ২০১৭ সালে অ-মুক্তিযোদ্ধা বলা হলেও ২০২১ সালের পুনঃযাচাইয়ে ‘ক’ তালিকা অর্থাৎ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক আবেদন একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমেও যাচাই করা হচ্ছে। সেখানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনেও দ্বিধাবিভক্তি পাওয়া গেছে।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সমকালকে বলেন, ‘কিছু মুক্তিযোদ্ধা আছেন যাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অভিযোগ পেলে সাধারণত প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তের ভাতা বন্ধ রেখে অভিযোগের শুনানি করা হয়। গেজেট বাতিল করতে হয় শুনানির পর। পরে দেখা যায় সংশ্লিষ্ট উপজেলারই মুক্তিযোদ্ধারা তথ্যপ্রমাণসহ বাতিল হওয়া ব্যক্তির পক্ষে আবেদন করছেন। তখন পুনঃশুনানি হয় এবং হয়তে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিও পুনর্বহাল করা হয়। আইন ও বিধির আলোকে এসব করতে গিয়ে মন্ত্রণালয় বেকায়দায় রয়েছে।’

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সবাই একই মানসিকতার নন। কেউ কেউ আর্থিক বা অন্য কোনো সুবিধা নিয়ে ভুয়া সাক্ষী দেন, মিথ্যা অভিযোগও দেন। এ সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধীরাও অতীতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। আবার সব অভিযোগই হয়রানিমূলক তাও নয়। এসব ক্ষেত্রে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্তের পর অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হচ্ছে।’

জামুকার তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে ১৬ হাজার ৯৬০ জন ব্যক্তির আবেদন আপিল কমিটিসহ বিভিন্ন শাখায় নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর ২০১৭ সালে প্রথম দফা ( ক তালিকা) সুপারিশপ্রাপ্ত হলেও পরে আবার স্বীকৃতি বাতিল হয়েছে– এমন ব্যক্তির সংখ্যা ২ হাজার ১৪২। তাঁদের পুনরায় যাচাই-বাছাই হবে। অন্যদিকে, পুলিশ বাহিনীর ১ হাজার ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা, বেসামরিক গেজেটের ৫০৮ জনসহ প্রায় ২ হাজার ব্যক্তির আপিল বা গেজেটভুক্তির আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

গোয়েন্দা টক্কর : ২০০৫ সালে গেজেটভুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক সম্পর্কে সাত বছর পরে অভিযোগ উঠলে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত হয়। তাতে ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি তাঁর স্বীকৃতি বাতিল করে মন্ত্রণালয়। তিনি ‘অ-মুক্তিযোদ্ধা’ হয়ে যান। তখন তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাঅধিদপ্তর (ডিজিএফআই) পুনঃতদন্ত করে। এই সংস্থার প্রতিবেদন ও উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষ্যে জহিরুল আবার ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা’ হতে চলেছেন; গত ১৭ জানুয়ারি জামুকা নতুন গেজেট করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
নোয়াখালীর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলামসহ আরও অনেকের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে।

মামলা, মামলা : প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও অ-মুক্তিযোদ্ধা প্রশ্নে বিরোধ গড়িয়েছে উচ্চ আদালতেও। মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ৬২৭টি রিট বিচারাধীন। কয়েকটি মামলা পর্যালোচনায় দেখা যায়, বরিশাল মহানগরে ‘ক’ তালিকাভুক্ত ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গেজেটভুক্তির জন্য রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও বিধি অনুযায়ী উপজেলার মোট মুক্তিযোদ্ধার ১০ শতাংশের বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না– মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত তাঁরা চ্যালেঞ্জ করেন হাইকোর্টে। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে বিষয়টি সম্প্রতি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অপর একটি মামলায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের ১৩ মে গাজীপুরের ১৫ মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করে মন্ত্রণালয়। পরে তাঁরা দুটি রিট করলে হাইকোর্ট ১৫ জনের ভাতা চালুর নির্দেশ দেন। জামুকা নথিপত্রসহ ফের শুনানি করে। সেখানে একজন অনুপস্থিত ছিলেন এবং ১৪ জনের স্বীকৃতি পুনর্বহালের আবেদন নামঞ্জুর হয়। বিষয়টি আবারও আদালতে গড়িয়েছে।

জানা যায়, মামলাসহ নানা কারণে দেশের ৪০টি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে ।

ভিড়, হয়রানি : রাজধানীর কাকরাইলে জামুকা কার্যালয় ও আবদুল গণী রোডে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দেখা যায় প্রতিনিয়ত আপিল আবেদনকারী ও মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা, ভিড়। অনেকে টাকাপয়সা লেনদেন ও হয়রানির অভিযোগ করেন।
সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে আসা কুমিল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ জানান, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী মমতাজ বেগম ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) ৩২৭ নম্বর বেডে ২২ দিন ধরে ভর্তি আছেন। ক্যান্সার ধরা পড়ায় তাঁর ব্যয়বহুল কেমো চিকিৎসা দিতে হবে। জয়নালের ভাতা বন্ধ থাকায় তা চালু করার আশায় তিনি এসেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭১ সালে জয়নাল ও হারুন উভয়েই সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ২ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন গফুরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পান। জয়নালের ভাতা হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী স্থানীয় সোনালী ব্যাংকে যান। তখন তাঁকে ঢাকায় মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মমতাজ বারবার খবর নিচ্ছেন তাঁর স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চালু হয়েছে কিনা।

আরও জানা যায়, গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য মন্ত্রণালয়ের এমআইএসে (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) হালনাগাদ করা হচ্ছে। জয়নালের তথ্যাদি যাচাইয়ের জন্য ভাতা বন্ধ রয়েছে। তাঁর তথ্যাদি ২২ মার্চ পাওয়া গেছে। এমআইএসে হালনাগাদের পর শিগগির ভাতা চালু হবে।
বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শাহরিয়ার কবির সমকালকে বলেন, ‘পুরো বিষয়টি আমলানির্ভর। দুর্নীতি হচ্ছে। তাই বারবার সিদ্ধান্ত বদলায়। শুধু অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা চালু হলে এ ধরনের অনৈতিক প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাও আত্মসম্মান নিয়ে গৌরবান্বিত হবেন।’

বিষয় : প্রকৃত-ভুয়া দ্বন্দ্বে বেসামাল

মন্তব্য করুন