
‘আমাগে পানির ম্যালা কষ্ট। এই কষ্টে গ্রাম ছাইড়ে শরে আইছি। এনেও বৃষ্টির পানিতে ডুইবতে হচ্ছি। শীতকালি কষ্ট ম্যালা বাড়ে। এই লোনা পানি আমাগের জীবনটা শেষ কইরে দিলো’– এভাবেই বলছিলেন মরিয়ম আক্তার। ২০১২ সালে মা-বাবার হাত ধরে দাকোপের গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেন খুলনা শহরের বাঁশপট্টি বস্তিতে। ছোট্ট সেই মরিয়ম এখন অনেকটাই বড়। বছর দুয়েক আগে এ কিশোরীর বিয়েও হয়েছিল। সংসারে আসে ছেলে সন্তান। এক বছরের সেই সন্তান কোলে নিয়ে সমকালের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন মরিয়ম, তখন তিনি আগুনমুখ, দু’চোখে জলধারা। কারণ কয়েক মাস আগেই স্ত্রী-সন্তান রেখে স্বামী ছেড়েছেন ঘর। এ কিশোরী বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই পানির কষ্ট দেখছি। কারও বাড়িতে গেলে এক বেলা ভাত খাতি পারবেন সহজে। কিন্তু এক ঘড়া পানি কেউ আপনারে দেবে না। আর সহ্য করতে না পেরে শহরে চলে এসেছি। এখানে বর্ষাকালে ঘরে কোমর পানি থাকে। আর শীতকালে পানির অভাবে কলসি নিয়ে ছুটতে হয়।’
এ বস্তিতে ২০ পরিবারের বাস। এলাকার এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতি হাত জায়গা ১৫০ টাকায় মেপে ভাড়া দিয়ে তাঁরা ঘর তুলে এখানে থাকেন। নুরজাহান আক্তার তিন ছেলে-মেয়ে ও স্বামী নিয়ে আট বছর ধরে বাঁশপট্টি বস্তিতে থাকছেন। স্বামী করেন একটি রাইস মিলে চাকরি। আর ছেলেমেয়ে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়ে।
কয়রার আমাদিয়া গ্রাম থেকে আসা এ বস্তির বাসিন্দা নুরজাহান বলেন, ‘এখানেও শান্তি নেই। ঝড়-তুফানের রাইতে ঘরে ঘরে পানি উঠে যায়। টয়লেটের পানি, বর্ষার পানি সব আইয়া ঘরের ভিতরে ঢুকে।’
নুরজাহানের পাশে দাঁড়িয়ে আমেনা বেগম বলেন, ‘গু-মুতের পানিতেই বর্ষাকালে থাকা লাগে। পোলাপাইন নিয়ে তখন সীমাহীন কষ্টে দিন কাটে।’
বাঁশপট্টি বস্তিতে ১২৩ পরিবারের জন্য টয়লেট আছে মাত্র একটি। খুলনার কয়রার নকশা গ্রাম থেকে এখানে আশ্রয় নেওয়া রাহেনা বেগম বলেন, ‘সকালে সিরিয়ালে থাকা লাগে। কষ্ট হয় অনেক। কিছু করার নাই। দিনে পানিটানি কম খাই। সকালে পুরুষ লোকেরা কাজে যায়, সিরিয়াল পড়ে। আমরা মেয়েরা তখন আর যেতে পারি না। মহিলা মানুষের কষ্ট বেশি, আমাদের অনেক চাইপা থাকন লাগে। এত পুরুষ লোকের ভিড়ে তো আর আমরা যাইতে পারি না।’
লবণ পানি থেকে অনেকটা পালিয়ে বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে উপকূলীয় এলাকার মানুষ খুলনা শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। ঘরছাড়া মানুষের তালিকা লম্বা হচ্ছে। ঠিকানাহীন এই মানুষের মধ্যে নতুনদের সংখ্যা অনেক। মায়ার বাঁধন ছেড়ে শহরে আসা মানুষের জীবন এখানে নতুন পরীক্ষায় ফেলে প্রতিমুহূর্তে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, নগরে ছোট-বড় ৪০টি বস্তি রয়েছে। এসব বস্তিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, জলবায়ু উদ্বাস্তুরা ঠাঁই নিচ্ছেন।
তেমনই একটি নগরীর ২১ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রিনল্যান্ড বস্তি। এখানে হাজারো মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে বাস করছেন। নগরীর সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালের পাশে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে গড়ে উঠেছে খোঁড়াবস্তি। এখানেও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩০-৪০টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার বাস করছে।
শেরেবাংলা রোডের হীরার বস্তিতে ২৪ পরিবারের দুই শতাধিক লোক বাস করে। এ বস্তির বাসিন্দা আজিজুল হক বলেন, ‘তিন মাস ধইরে আমাগে বস্তির একমাত্র কলে পানি ওঠে না। অনেকরে জানালিও কেউ গুরুত্ব দেয় না। পানির জন্যি এখানে ওখানে দৌড়িয়ে বেড়াই।’
তবে খুলনা শহরের লবণচরার জামাল রাইস মিল বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, এখানে পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা বেশ উন্নত। ওয়াটারএইড বাংলাদেশে বসিয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এক জনপদ। ২০০৯ সালে আইলার পর পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে টিকতে না পেরে গাবুরার আট হাজারের মধ্যে তিন হাজার পরিবারই আবাসস্থল ছেড়ে চলে গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা লিডার্স। এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন, শুধু গরিব মানুষই নয়, এই এলাকার বিত্তশালীরাও এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যাঁরা বিত্তবান, তাঁরা এই এলাকায় বাসের উপযোগী নয় বলে শহরে গিয়ে থাকছেন। যাঁরা গরিব, তাঁদের বড় একটি অংশ খুলনা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে কাজের আশায় গেছেন। এ ছাড়া কিছু গেছেন ভারত। যাঁরা একটু সচ্ছল, তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন। উদ্বাস্তু হওয়া ৮০টি পরিবারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, খাবার পানির সংকটের কারণেই তাঁরা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া অভাব এবং পেশা হারানোর মতো কারণতো আছেই। লবণপানির কারণে কৃষকরা পেশা হরিয়েছেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, লবণাক্ততার কারণে পুরো বাস্তুসংস্থান বদলে যাচ্ছে। মানুষের রোগব্যাধি বাড়ছে, নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়ছেন। একসময় দেখা যাবে, শুধু পানির কারণে মানুষের স্থানান্তর আরও বেড়ে গেছে।
সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এই মার্চের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানীয় জলের অভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে বর্তমানে মোংলার ৮০ শতাংশ এবং শ্যামনগরের ৭০ শতাংশ পরিবার স্থানান্তরণের শঙ্কায় রয়েছে।
ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, উপকূলে পানির সমস্যা নিয়ে বড় পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রথমেই ভূগর্ভস্থ পানি পরিমাপ করা দরকার। মাটির নিচে পানির কী অবস্থা, সেটা জানা দরকার।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরির্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, অনেক মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হচ্ছেন। যাঁরা ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি হারাচ্ছেন, তাঁদের জন্য সরকার কাজ করছে। তাঁদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। (শেষ)
মন্তব্য করুন